বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তর ও প্রথম স্বাধীন জেলা যশোরের প্রথম ও একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি)। উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমে আধুনিক জ্ঞান চর্চা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০৭ সালের ২৫ জানুয়ারি, যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের সাজিয়ালী মৌজার আমবটতলা নামক স্থানে ৩৫ একর জায়গাজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
হাঁটি হাঁটি করে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৭ বছরপূর্তি উদযাপন করেছে যবিপ্রবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও ভাবনা তুলে ধরছেন যবিপ্রবি সংবাদদাতা শিহাব উদ্দিন সরকার।
শোয়েব মোহাম্মদ: যবিপ্রবি বরাবরই আমার কাছে অন্যরকম এক আবেগ এর স্থান- যেখানে আমি শিখেছি, যেখানে একদল জ্ঞান পিপাসু মানুষের সান্নিধ্য আমাকে প্রতিনিয়ত সিক্ত করেছে অপার মমতায়। আর এই আলিঙ্গন ই আমার মননকে গড়ে তুলে আজকের আমিতে পরিণত করেছে আমাকে। স্মৃতিচারণ করতে গেলে, যবিপ্রবির সাথে আমার সম্পর্কের শুরু সেই ২০১৫ সাল থেকে, যখন কেউই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটা পর্যন্ত জানত না, সেখান থেকে আজ ২০২৪ এ এসে অনেকে ই আমার কাছে যবিপ্রবির ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে থাকেন। এই কয়েকটি বছরে যবিপ্রবি ঠিক কতটুকু এগিয়েছে তা বোঝাবার জন্য এতটুকুই মনে হয়ে যথেষ্ট। আর গবেষণায় কতটা এগিয়েছে সেটা হয়ত পুরো দেশবাসী মনে করতে পারবেন করোনাকালের কথা মনে করলে। একুশে পদক বিজয়ী বিজ্ঞানী যবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন স্যারের নেতৃত্বে দেশের ক্রান্তি লগ্নে দেশকে সেবা দিয়েছে, তা হয়ত কারোরই অজানা নয় । অথবা আইপিই বিভাগ যেভাবে স্থানীয় শীল্প উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে বিভিন্ন টেস্টিং করে, মোল্ড তৈরি করে ও মেশিন ডেভলপমেন্ট এর মাধ্যমে সেটা হয়ত যশোরের আশপাশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আজ যবিপ্রবির গ্রাজুয়েটরা আলো ছড়াচ্ছেন দেশ বিদেশের অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে। যবিপ্রবি এতদিনে অন্তত স্বপ্ন দেখতে শিখেছে, স্বপ্ন দেখাতে শিখেছে। কিন্তু যেতে হবে বহুদূর, নিজের অস্তিত্ব বিশ্বে জানান দিতে নিতে হবে দৃঢ় শপথ। মানবকল্যাণে, দেশের কল্যাণে হবে শিক্ষা ও গবেষণা এই হোক আজ এই শুভলগ্নের অঙ্গীকার।
প্রভাষক,ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড প্রোডাকশন ইন্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগ, যবিপ্রবি
মো. নাজমুল হোসাইন: বর্তমান উপাচার্য একুশে পদকপ্রাপ্ত অনুজীব বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন স্যারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে যবিপ্রবি আজ বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। শিক্ষা ও গবেষণা খাতে যবিপ্রবি আজ অনেক এগিয়ে গেছে । মাত্র একযুগে উচ্চশিক্ষায় অনন্য সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ২০১৯ এর শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হয়, যেখানে অনেক পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো হিমশিম খাচ্ছে। দেশের ক্রান্তিলগ্নে ২০২০ সালে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে যবিপ্রবি জিনোম সেন্টার বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে করোনাভাইরাস পরীক্ষা শুরু করে। নিজস্ব ল্যাবে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এটা ছিল দেশে প্রথম। আমি মনে করি এটি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে পেরে আমি গর্বিত। যবিপ্রবিতে রয়েছে অত্যাধুনিক ল্যাব, অনেক পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও যা এখনো নেই।
যবিপ্রবির সিএসআইআরএল এবং জিনোম সেন্টার আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রকারী প্রতিষ্ঠান আইএসও-এর সনদ অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গুণগত মান বজায় রাখায় এরমধ্যে যবিপ্রবির নেম ল্যাব আইএসও সনদ অর্জন করে। বাংলাদেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর যশোর জেলার বেনাপোল পোর্ট দিয়ে আমদানীকৃত প্রোডাক্টের মান নির্ণয় করতে আস্থার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে যবিপ্রবির সিএসআইআরএল ল্যাব। যবিপ্রবিতে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের বৃহত্তম হ্যাচারি-কাম-ওয়েট ল্যাব। স্থাপন করা হয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শেখ রাসেল জিমনেশিয়াম। যবিপ্রবিতেতে আছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ মৎস্য সংরক্ষণশালা ‘অ্যাকুয়াটিক বায়োডায়ভার্সিটি মিউজিয়াম’।
সাম্প্রতিক সময়ে ক্রীড়াঙ্গনে যবিপ্রবি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস, জাতীয় এ্যাথলেটিক্স, অলিম্পিক, সাফ চ্যাম্পিয়নশীপ, বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া সবকিছুতেই সাফল্যের ধারা অব্যাহত রেখেছে যবিপ্রবি। কৈশোর পেরিয়ে অনেক প্রবীণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে টপকিয়ে যৌবনে পা দেওয়া যবিপ্রবি এখানেই অনন্য।
তথ্য কর্মকর্তা, যবিপ্রবি সাবেক শিক্ষার্থী, এগ্রো প্রোডাক্ট প্রসেসিং টেকনোলজি (এপিপিটি) বিভাগ, যবিপ্রবি।
মোসাব্বির হোসাইন: যবিপ্রবি নবীন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্বেও শিক্ষা, গবেষণা ও খেলাধুলার মাধ্যমে দেশের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। মাত্রই কিশোর বয়স পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছে, এরমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় তার সৌন্দর্য, রূপ ও জৌলুস প্রকাশ করতে শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠার মাত্র আঠারো বছরে আমাদের প্রাপ্তির ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে অনেক কিছু। গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে সারাদেশে জায়গা করে নিয়েছে যবিপ্রবি। ২০২১ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে একুশে পদক প্রাপ্ত হন বিশিষ্ট অনুজীব বিজ্ঞানী যবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন। প্রতি বছর এলসেভিয়ার ও স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, সম্মিলিতভাবে ওয়ার্ল্ড টপ ২% বিজ্ঞানীদের একটি তালিকা প্রকাশ করে থাকে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গবষণা প্রবন্ধ প্রকাশের অনুপাতে যবিপ্রবির অবস্থান বর্তমানে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাপিয়ে প্রথম স্থানে রয়েছে। গবেষণায় চৌকস যবিপ্রবির শিক্ষকগণ বিশ্বের ২% বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন।
ছাত্ররাজনীতির সুষ্ঠু চর্চা, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে ছাত্র সংসদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অতি দ্রুত প্রয়োজন। মুক্তবুদ্ধি চর্চার জন্য ক্যাম্পাসে নেই, কোনো মুক্তমঞ্চ। খেলাধুলা করার জন্য নেই পর্যাপ্ত জায়গা আর মানসিক বিকাশের জন্য নেই চিত্ত-বিনোদনের মাধ্যম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমি হিসেবে প্রত্যাশা রাখছি, সর্বদা শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত হোক, সমৃদ্ধ হোক গবেষণাক্ষেত্র। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর রোল মডেল হোক সেই প্রত্যাশা করছি। বেঁচে থাকুক যবিপ্রবির আকাশে ঝলঝল করতে থাকা অপার সম্ভাবনাময়ী প্রতিজন গর্বিত যবিপ্রবিয়ান।
স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি (এনএফটি) বিভাগ, যবিপ্রবি
রাশেদ খান: যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে যাত্রা শুরু করে এখন অবধি শিক্ষা, গবেষণা,খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে৷ এই সফলতায় যবিপ্রবি পরিবারের সকল সদস্য এবং যশোরবাসী গর্বিত। সমসাময়িককালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে তুলনা করলে গ্রাজুয়েশন শেষে শিক্ষার্থীদের চাকরি প্রাপ্তি, উচ্চ শিক্ষার জন্য উন্নত দেশে গমন কিংবা গবেষণার হারও ঈর্ষনীয়ভাবে বেশি!
তবে এতো প্রাপ্তির মধ্যেও কিছু হতাশা আছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক সকল সুবিধা এবং আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলেও বিভিন্ন অযাচিত উচ্চ ফি, ডাইনিং সমস্যা, ক্যাফেটেরিয়ার অব্যবস্থাপনা,পরিবহন সংকট, ২৪/৭ জরুরি চিকিৎসা সেবা না পাওয়া, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির নিমিত্তে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দ্বারা ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া যবিপ্রবির প্রগতির পক্ষে বড় বাধা। যবিপ্রবিতে স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব কমিয়ে, ক্যাম্পাসকে শিক্ষার্থীবান্ধব করতে উপাচার্য সফল হয়েছেন, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, ডিপার্টমেন্টের স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা ব্যক্তিগত আক্রোশের ফলে কোনো শিক্ষার্থীর একাডেমিক এবং ব্যক্তিগত জীবন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকেও নজর রাখা জরুরি৷
শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকদের পাঠ মূল্যায়ন সময়ের দাবি। যবিপ্রবির দেড় যুগ পূর্তিতেও একটা অফিসিয়াল এলামনাই গঠিত না হওয়াটা অপ্রত্যাশিত। তবে যবিপ্রবির দেড় যুগের এই নিরন্তর পথচলায় অপ্রাপ্তির চেয়ে প্রাপ্তির পাল্লাটা অনেক বেশি ভারি।
স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, যবিপ্রবি।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ