ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

 জাবিতে ময়লার ভাগাড়, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য

প্রকাশনার সময়: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:১২ | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:২১

নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালায় ঘেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। তবে সবুজে ঘেরা এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমেই পরিণত হচ্ছে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে। গত ৫২ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠেনি কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র। ফলে ক্যম্পাসের সার্বিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র ও পরিযায়ী পাখি বর্তমানে হুমকির মুখে পড়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট শাখা সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে প্রতিদিন প্রায় ১ টন বিভিন্ন প্রকারের বর্জ্য জমা হয়। সমগ্র ক্যাম্পাসের ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য মাত্র ৩০ থেকে ৪০টি ডাস্টবিন রয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপর্যাপ্ত।

ক্যাম্পাসে প্রায় প্রতিদিনই রাজধানী ও এর আশেপাশের এলাকা থেকে ঘুরতে আসে অসংখ্য দর্শনার্থী। ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের ফেলে যাওয়া ময়লা-আবর্জনা, পানির বোতল, প্যাকেটজাত খাবারের মোড়ক, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পর ফেলা খাবারের প্যাকেট, ভ্রাম্যমাণ দোকানদারদের ফেলা আবর্জনায় প্রতিনিয়ত নোংরা হচ্ছে ক্যাম্পাস। এছাড়া অতিথি পাখি অবস্থান করা লেকগুলোর পানিতেও ভাসছে বোতল-প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন আবর্জনা। কয়েকটি লেকের পাড়ে দেখা গেছে আবর্জনার স্তূপ। ক্যাম্পাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কমিটির থাকলেও তারা ঠিকমতো সেই কাজ করছে না বলে অভিযোগ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ক্যম্পাসের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা বটতলায় মাত্র ১টি, মুরাদ চত্ত্বরে ১টি, ট্রান্সপোর্টে ২টি, চৌরঙ্গীতে ১টি ডাস্টবিন রয়েছে। পর্যাপ্ত ডাস্টবিন না থাকায় শিক্ষার্থী, বহিরাগতসহ সকলেই যত্রতত্র ময়লা ফেলছে। ফলে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি জনজীবন ব্যাহত হচ্ছে।

এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকাকে দায়ী করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, 'আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। এখন শুধু বর্জ্য সংগ্রহ করে ডাম্পিং করা হয়। কিন্তু এটা পরিবেশের জন্য সুখকর কিছু নয়, বরং ক্ষতিকর। কারণ এখান থেকে প্রতিনিয়ত রোগ-বালাই ছড়াচ্ছে, ক্যাম্পাসের নান্দিনকতা নষ্ট হচ্ছে, এমনকি সার্বিক জনজীবন ব্যাহত হচ্ছে।'

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র না থাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এক ধরনের উদাসীনতা বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব উদ্যোগে এখনো কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র গড়ে উঠেনি। এটা তো এক ধরনের উদাসীনতা। একসময় পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপকের নিজস্ব উদ্যোগে ও অর্থায়নে একটি বায়োগ্যাস মিল চালু ছিল, কিন্তু তা ২০২০ সালের মার্চ মাসে পর্যাপ্ত বাজেটের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এখান থেকে উৎপাদিত গ্যাস সেল করা হতো, কিন্তু এখন আর তা হয়না না।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে গড়ে ওঠা খাবারের দোকানের বর্জ্য দোকানিরা দোকানের আশেপাশেই ফেলে। অনেকদিন থেকে দোকানের পাশেই ময়লা ফেলার এই প্রথা চলে আসলেও প্রশাসনকে এ বিষয়ে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

এস্টেট শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার আব্দুর রহমান বলেন, 'আমরা দোকানিদের যত্রতত্র ময়লা ফেলার ব্যাপারে বারংবার সতর্ক করেছি। এরপরও যদি তারা না শুনে তাহলে শীঘ্রই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

ময়লা-আবর্জনার দিক থেকে পিছিয়ে নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো। হলের আশাপাশে তৈরি হয়েছে বিশালাকারের ময়লার স্তূপ। এসব ময়লা প্রায়ই পুড়িয়ে ফেলা হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি হলে থাকা শিক্ষার্থীরা প্রায়ই বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির শিকার হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দিন বলেন, 'ময়লা-আবর্জনা পুড়িয়ে ফেললে আসলে কোনো লাভ হয় না। বরং এটা পরিবেশের জন্য আরও ক্ষতিকর। পুড়িয়ে ফেলা ছাই পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। এছাড়া এখান থেকে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিসঃরণ হয়, তা যেমন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি শরীরের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য রোগব্যধি দেখা দিতে পারে।'

একটি সমন্বিত কমিটি গঠন করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, 'সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে একটি সমন্বিত কমিটি করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যেকোনো একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে যে রিসোর্স ডেভলপমেন্ট হবে তা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যাবে এবং ব্যবস্থাপনার খরচ পুষিয়ে ওঠবে।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্জ্য অপসারণের জন্য মাত্র ৬৫ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী কাজ করছেন। ক্যাম্পাসে বর্জ্য অপসারণে পর্যাপ্ত লোকবল না থাকাকে দায়ী করেছেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার আব্দুর রহমান। তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে মাত্র ৬৫ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন। ক্যাম্পাসে প্রতিদিন যে পরিমাণ আবর্জনা হয়, তার জন্য ৬৫টি জন খুবই অপর্যাপ্ত। অন্তত ১০০ এর অধিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছাড়া কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনা করা কঠিন।'

সংশ্লিষ্ট সাথে আলোচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও লোকবল সংকট নিরসনের চিন্ত-ভাবনা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু হাসান। তিনি বলেন, 'লোকবল বাড়ানোর ব্যাপারটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। লোকবল বাড়ানোর দরকার কিনা, কতজন লাগবে এটা সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র নিয়ে সংশ্লিষ্টদের একটি মিটিং হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু নানা জটিলতায় তা আর হয়নি। তবে এ বিষয়ে ভবিষ্যতে প্রশাসনের আলাপ-আলোচনার চিন্তা ভাবনা রয়েছে।'

নয় শতাব্দী/এসএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ