ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাবির বাংলা বিভাগে পড়তে চান পাকিস্তানি তরুণ

প্রকাশনার সময়: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৯:৪৯ | আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৯:৫১

বাংলা ভাষার মোহে সুদূর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এসেছেন মোহাম্মদ তাহির। শুধু কথা বলতে নয়, বাংলা ভাষায় লিখতেও পটু তাহির। এমনকি তার মুখে শোভা পায় বাংলাদেশের নানা দেশাত্মবোধক ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান। শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষা শেখা ও এই দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলা সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন তাহির। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ার সুযোগ না পেয়ে আক্ষেপ করেছেন পাকিস্তানি এই শিক্ষার্থী।

তবে তাহিরের এই আক্ষেপের মাঝে আশার আলো জোগাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলেন, ‘আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হতে চাই। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তির ক্ষেত্রে কিছু প্রসেস অনুসরণ করতে বলেছেন।’

এরআগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেন তাহির। কিন্তু ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিন্ডিকেট সভায় পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যায়তনিক, গবেষণামূলক, সাংস্কৃতিকসহ সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সেখানে তিনি ভর্তি হতে পারেননি। ফলে আক্ষেপের স্বরে বলেন, ‘ঢাবিতে পাকিস্তানি শিক্ষার্থীরা পড়তে পারবে না শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছে। কিন্তু শিক্ষা তো দূরত্ব কমিয়ে মানুষকে মানুষের কাছে নিয়ে আসে, শিক্ষার মাঝে রাজনীতি থাকলে প্রকৃত শিক্ষা পাওয়া যায় না৷’

তবে তাহিরের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (শিক্ষা) সৈয়দ মোহাম্মদ আলী রেজা বলেন, ‘পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে তার সম্পর্কে আমাদের জানানো হয়েছে। আমরাও চাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীরা আসুক। তবে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রসেস অনুসরণ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলতে হবে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটা নির্বাচিত তালিকা দিবে। তালিকা হাতে পেলেই আমরা তাকে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের জন্য এপ্রুভ করতে পারব।’

জানা গেছে, লাহোরের গুজরানওয়ালা জেলায় বসবাস করেন মোহাম্মদ তাহির। তার বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক এবং মা গৃহিণী। তাদের একমাত্র সন্তান তিনি। নিজের প্রচেষ্টায় বাংলা বলা, লেখা ও পড়া শেখেন। এরপর তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে বাংলা পড়াশোনার পর্যাপ্ত পরিবেশ না থাকায় বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন তাহির। প্রায় চার মাস আগে বাংলাকে ভালোবেসে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসেন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতকের এই শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শামীমা সুলতানা জানান, বাংলা ভাষার প্রতি তার একটা ভালোবাসা ও অনুরাগ আছে। এ ভালোবাসার টানে সে পাকিস্তান থেকে এখানে এসেছে। তাকে ভর্তি করা যাবে কি-না এ বিষয়ে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে এখনো কিছু জানানো হয়নি। এখানে আমার একার সিদ্ধান্ত হবে না। প্রশাসন থেকে জানানো হলে বিভাগের সবার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। তবে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই।

১৯৫৩ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন বিভাগটি অনেক সমৃদ্ধ থাকলেও বর্তমানে জৌলুস হারিয়েছে। বাংলা পড়া ও শেখার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন তাহির। তিনি বলেন, ‘একসময় করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রায় ৪ হাজার শিক্ষার্থী পড়তেন। তখন সেখানে পড়াশোনার মান ভালো ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পড়াশোনার মান একেবারে কমে গেছে। প্রতিবছর এখানে মাত্র ১ বা ২ জন ভর্তি হয়। পূর্বে বিভাগটি ভালো অবস্থানে থাকলেও এখন অবস্থা খুবই বাজে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেখানে একজন অধ্যাপক এবং একজন প্রভাষক দিয়ে বিভাগটি চলছে। বইগুলো এত পুরনো যে, তার পৃষ্ঠা উল্টালেও ছিঁড়ে যায়। আমি করাচিতে বসবাসরত অনেক বাঙালিদের সঙ্গেও দেখা করতে যাই। কয়েকজনকে অনুরোধও করি বাংলা শেখাতে। কিন্তু তারা সময় করে উঠতে পারেননি।’

বাংলা ভাষার প্রতি তার এমন আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্কুলে তাদের পড়ানো হয় পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের দুটি অংশ ছিল। ভাষা ও সংস্কৃতি ভিন্ন হওয়ার কারণে একটি যুদ্ধ হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায়। যুদ্ধের কারণ ছিল বাঙালিদের বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। এরআগে বাঙালিরা তাদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রতিবাদ শুরু করে। মূলত তাদের অধিকার আদায়ের বিষয়গুলো আমাকে তাদের সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করে তোলে। তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলা সম্পর্কে জানতে আমি উৎসাহিত হই।’

তাহির বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ ও এখানকার ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে পাকিস্তানিদের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। এখানকার ভাষা, সংস্কৃতি পাকিস্তানে পরিচিত করার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ভাষার মাধ্যমে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের কাছে নতুনভাবে পরিচিত করা যাবে। একই সাথে মুক্তিযুদ্ধে ন্যাক্কারজনক ঘটনায় বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটি জাতীয় দাবিতে পরিণত হবে।

তাহির বর্তমানে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে পাকিস্তানি অনেক শিক্ষার্থীদের বাংলা শেখাচ্ছেন। তার স্বপ্ন এদেশ থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাঠ চুকিয়ে পরবর্তীতে পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে সেখানকার শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা।

নয়া শতাব্দী/এসএ/এমটি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ