কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) মোসা. ফুলপরী খাতুন ওরফে ফুলপরীকে নিয়ে ঘটে যাওয়া র্যাগিংয়ের ঘটনা ছিল দেশজুড়ে আলোচিত। ঘটনাটি গড়ায় আদালত পর্যন্ত। গাজী মো. মহাসীন নামের এক ব্যক্তির রিট দায়েরের ফলে ঘটনা তদন্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন আদালত। এরপর গঠিত হয় একাধিক তদন্ত কমিটি। তদন্ত শেষে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে সাময়িক বহিষ্কার করা হয় পাঁচ ছাত্রীকে। এরপর ওই পাঁচ শিক্ষার্থীকে শোকজ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ সময় ত্রুটিপূর্ণ নোটিশ দিয়ে আদালত কর্তৃক ভর্ৎসনার শিকার হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি। তবে ভয়ে-আতঙ্কে সে সময় বিষয়টি নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কথা না বললেও এখন মুখ খুলছেন অনেকেই।
নয়া শতাব্দীর হাতে এসেছে ইবি শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরাসহ কয়েকজন ফুলপরীকে জেরার ১ ঘণ্টা ৪৪ মিনিটের একটি অডিওসহ অন্তত ১০টি অডিও রেকর্ড। এতে পুরোনো ঘটনাই নতুন মোড় নিয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আঙুল তুলছেন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে। অভিযোগ উঠেছে— ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয় এমন ছাত্রীকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। আবার সংগঠনের কোনো পদে না থাকলেও ৪ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ!
ফুলপরীর অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ৭ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা হলের ৩০৬ নম্বর রুমে তার এক পরিচিত আপুর কাছে গেস্ট হিসেবে ওঠেন তিনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী গেস্ট হিসেবে কাউকে হলে উঠতে হলে গেস্ট কার্ড নিতে হয়। কিন্ত তিনি এ নিয়ম মানেননি। এরপর ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি সানজিদা চৌধুরী অন্তরার নেতৃত্বে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী তাবাস্সুমসহ ৭ থেকে ৮ জন তাকে দুই দফা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে এবং তাকে বিবস্ত্র করে তার গোপন ভিডিও ধারণ করে রাখেন। সেইসঙ্গে তাকে দিয়ে একটা ময়লা গ্লাস চাটিয়ে পরিষ্কার করিয়ে সেটার ভিডিও ধারণ করে রাখারও অভিযোগ আনা হয়। তবে হলের প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এবং অডিওগুলো বিশ্লেষণ করে এসব ঘটনার আংশিক সত্যতা পাওয়া গেলেও ফুলপরীকে বিবস্ত্র করে এবং ময়লা গ্লাস চাটিয়ে পরিষ্কার করার ভিডিও ধারণের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হলের একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী নয়া শতাব্দীকে জানিয়েছেন, ‘ফুলপরীকে এলোপাতাড়ি মারধরের অভিযোগ ভিত্তিহীন। সেইসঙ্গে তার জামাকাপড় খুলে ভিডিও ধারণ এবং তাকে দিয়ে ময়লা গ্লাস চাটিয়ে পরিষ্কার করানোর অভিযোগও সত্য নয়। তবে তাকে হালকা চড় থাপ্পড় দেয়া হয়েছে এবং গালিগালাজ করার অভিযোগ সত্য।
জানা যায়, হলে ওঠার পর থেকেই সিনিয়র-জুনিয়র কাউকে তোয়াক্কা করতেন না ফুলপরী। কেউ কিছু বললে তাকে ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতা-নেত্রীদের নাম নিয়ে হুমকি-ধমকি দিতেন। অডিও বিশ্লেষণে জানা যায়, ফুলপরী কখনো বলতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়েত মৈত্রী হল সভাপতি রাজিয়া সুলতানা কথা তাকে হলে উঠিয়েছে, কখনো কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী নিশি আবার কখনো সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্রলীগের কথিত সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আল আমিন। এমনকি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা তার ফুফাতো বোন বলেও বিভিন্নজনদের হুমকি দিতেন। কেউ কিছু বললে অন্তরাকে বলে তাকে হল থেকে বের করে দেয়ারও হুমকি দেন। তবে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুলপরীকে আপনি হলে উঠিয়েছেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়েত মৈত্রী হলের সভাপতি রাজিয়া সুলতানা কথা নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আমি আসলে এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’
ফুলপরীর রেফারেন্সে হলে ওঠায় সিনিয়রদের পাওয়ার দেখাচ্ছিলেন বলে ধারণা হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের। বিষয়টি জানতে পেরে ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ফুলপরীকে ডেকে এসব ঘটনার বিষয়ে জেরা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা। জেরার এক পর্যায়ে ফুলপরীর কাছে ঘটনার বিষয়ে জানতে চান অন্তরা, না চিনে অন্তরাকেও ফুলপরী বলেন, আমাকে অন্তরা আপু হলে উঠাইছে। এরপর নিজের পরিচয় দিয়ে অন্তরা জানতে চাইলে ফুলপরী তাকে ‘সরি’ বলেন। অডিওতে অন্তরাকে বারবার বলতে শোনা যায়, ‘তুমি আমার নাম বলে সবাইকে থ্রেট দিয়ে বেড়াচ্ছ।’ এরপর অডিও রেকর্ডের ১ ঘণ্টা ১৪ মিনিট ১৫ সেকেন্ডে শোনা যায়, ঢাকা থেকে একজন ফোন দিয়ে নিজের নাম বলেন আল আমিন, পরিচয় দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে। আদতে সলিমুল্লাহ হলে আল আমিন নামের কোনো সাংগঠনিক সম্পাদক নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘটনার আগে অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারি রাতেই বিষয়টি হল প্রভোস্টেকে জানানো হয়। তবে প্রভোস্ট বিষয়টিতে তেমন ভ্রুক্ষেপ না করে পরদিন দুপুর ২টায় আসবেন বলে জানান (কল রেকর্ড নয়া শতাব্দীর কাছে রয়েছে)। তখনো ফুলপরীকে নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি হলের অধিকাংশ ছাত্রীদের লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফুলপরীকে হল থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন প্রভোস্ট। এ সময় ফুলপরী তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে প্রভোস্ট বরাবর লিখিত মুচলেকা দিয়ে পরবর্তীতে আর এ ধরনের কাজকর্ম না করার অঙ্গীকার করেন (মুচলেকা ও লিখিত আবেদনের কপি নয়া শতাব্দীর কাছে রয়েছে)। দরিদ্র পরিবার পরিচয় দেয়ায় ফুলপরীকে মানবিক বিবেচনায় হলে থাকার অনুমতি দেয়া হয়।
প্রশাসনের গাফলতি
ফুলপরী আগে ৩০৬ নম্বর রুমে থাকলেও পরবর্তীতে তাকে গণরুম (দোয়েল-১) এ রাখতে বলেন প্রভোস্ট। উল্লেখ্য, এই দোয়েল-১ এর মেয়েদের সঙ্গেই ফুলপরীর ঝামেলা চলছিল। প্রভোস্টের কথামতো ওই রাতে তাকে দোয়েল-১ পাঠানো হয়। ফলে ঘটে অনাকঙ্ক্ষিত ঘটনা। দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘মূলত হল প্রশাসনের দায়িত্বজ্ঞানহীন কাণ্ডের জন্যই এ ঘটনা ঘটেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, তাবাস্সুমসহ আরও কয়েকজন পূর্বের ক্ষোভ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে অন্তরার নাম বলে ফুলপরীকে র্যাগিং করেন। তবে এ বিষয়ে অন্তরার দাবি তিনি কিছুই জানতেন না এবং এ ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত নন।
জানতে চাইলে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের তৎকালীন প্রভোস্ট প্রফেসর ড. শামসুল আলম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বলেন, আমি এখন ওই হলের দায়িত্বে নোই। তাই আমি এ বিষয়ে কিছু বলব না।
পদে না থাকলেও বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ
ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার হওয়া একমাত্র অন্তরা ছাড়া বাকি কেউই ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী নয় এবং তারা ছাত্রলীগের কোনো পদ-পদবিতেও ছিল না বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত। কর্মী না হলে তাদের কেন বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ দায় নিল— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, আসলে আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলাম। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাঠিয়েছি। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নিউজের কাটিং চেয়েছিল আমরা ওটাও পাঠিয়েছি। এরপর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বহিষ্কার করেছে।
একই ধারায় শাস্তি দিয়ে শোকজ
বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কোড অফ কনডাক্টস অফ দ্যা স্টুডেন্টস’ ৫ ধারা এবং ২৭ ধারায় শোকজ করা হয়েছে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী সানজিদা চৌধুরী অন্তরাকে। ৫ ধারায় কেউ দেশের প্রচলিত আইনের চোখে অপরাধী এবং ২৭ ধারায় বলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে কোনো শিক্ষার্থী অভিযোগ উঠলে তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কিন্তু ৫ ধারায় ব্যবস্থা নিতে হলে দেশের প্রচলিত আইনে অপরাধী হতে হবে এবং আদালত কর্তৃক অপরাধী প্রমাণিত হতে হবে। কিন্তু ফুলপরী ইস্যুতে আদালতে কেউ মামলা করেনি এবং গঠিত তদন্ত কমিটি আবাসিকতা বাতিলের সুপারিশ করেছিল যেটি বাস্তবায়িত হয়েছে। সেক্ষেত্রে এ ধারায় আবার নতুন করে শোকজের জবাব চাওয়া ‘হাস্যকর’ বলছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান ও দেশরন্ত শেখ হাসিনা হলের বর্তমান প্রভোস্ট প্রফেসর রেবা মণ্ডল কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
নেপথ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শ
ফুলপরী কাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেও পারে এ বিষয়ে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয় বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সিন্ডিকেট মেম্বার ও অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যক্ষ মো. সাহজাহান আলম সাজু।
প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা বলেন, অনেকের ধারণা ইসলামী ছাত্রশিবির এক সময় এ ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থী ভর্তির বিরোধিতা করেছে। সেই ক্যাম্পাসে নারীরা এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ বিষয়টি তারা ভালোভাবে নিতে পারছে না। তাই তারা বিভিন্ন সময়ে নারী শিক্ষার্থীদের বিতর্কিত করার মিশনে নেমেছে।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর মো. শাহাদৎ হোসেন আজাদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ঘটনার পরদিন সকালে ফাস্ট আওয়ারে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, তিন স্তরবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়; তদন্ত হয়েছে। তিনি বলেন, আমার সহকারী প্রক্টররা জানিয়েছে, ‘এক সময় যারা আমাদের ক্যাম্পাসে শিবিরের রাজনীতি করত তারা ফুলপরীর পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়েছে। গাজী মোহসিনের সঙ্গে সঙ্গে আরও একাধিক আইনজীবী তার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে, এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ভুক্তভোগী ফুলপরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘ওই আবেদন কম্পিউটারে লেখা। তাছাড়া যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমি এ বিষয় নিয়ে এখন আর নতুন করে কিছু বলতে চাই না।’
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ