ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কুড়িগ্রামে পরীক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষক বেশি!

প্রকাশনার সময়: ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:১৯ | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ২০:২৩

কুড়িগ্রামের বেশ কয়েকটি উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। এবার জেলায় এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে ঘটেছে শতভাগ ফেল করার ঘটনাও। শিক্ষার্থী সংকট আর পড়ালেখায় শিক্ষার্থীর অনাগ্রহকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার খামার বড়াইবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক ১৪ জন, স্টাফ ৬ জন থাকলেও বিদ্যালয়ে ২০২১-২২ সেশনে ৯ম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেন ৪০ জন। কিন্তু ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ফরম পূরণ করেছিলেন ১৬ জন। অথচ পরীক্ষায় মাত্র চারজন অংশ নিয়ে সবাই এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করেছে। অংশ নেয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে দু’জন মেয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে পরীক্ষায় অংশ নেয়। আর বাকি দুই শিক্ষার্থী দারিদ্রতার কষাঘাতে কাজের জন্য ঢাকায় অবস্থান করে। সেখান থেকে এসে পরীক্ষা অংশ নেয়।

সদরের যাত্রাপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চিত্র প্রায় একই। এই বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করে ৫১ জন। এসএসসিতে ফরম পূরণ করে ৪০ জন আর পরীক্ষায় অংশ নেয় ৩৬ জন। যার মধ্যে ২০ জন পাশ আর ফেল করেন ১৮ জন। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক ১১ জন, স্টাফ চারজন।

আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ৯ম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করে ৪২ জন এবং এসএসসিতে ফরম পূরণ করে ৩০ জন। তারা সবাই পরীক্ষায় অংশ নিলেও পাশ করে ১৬ জন এবং ১৪ জন ফেল করে। এখানে শিক্ষকের সংখ্যা ৯ জন, স্টাফ ৪ জন এবং শূন্য পদ আছে ৪টি।

অনন্তপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ জন শিক্ষক ও ৫ জন স্টাফ কর্মরত থাকলেও পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে মাত্র চারজন। এরমধ্যে একজন ফেল। সুন্দরগ্রাম পুটিকাটা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৬ জনের মধ্যে ১২ জন ফেল করে। অথচ বিদ্যালয়ে ১৫ জন শিক্ষক এবং ৪ জন স্টাফ কর্মরত আছেন। পূর্ব কুমোরপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনজনের মধ্যে ফেল একজন। সারডোব আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সাতজনের মধ্যে তিনজন ফেল।

পূর্ব সূখ্যাতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঁচজন অংশ নিয়ে ফেল করেছে দুইজন। সমাজ কল্যাণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১০জন অংশ নিয়ে ফেল করে দুইজন।

একতা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২৫ জনের মধ্যে ১৬ জন ফেল করে। নগরাজপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৬ জনের মধ্যে ১১ জন ফেল। আজোটারি মাস্টার পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১৮ জনের মধ্যে ৯ জন ফেল। শংকর মাধবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ জনের মধ্যে সাতজন ফেল। রাঙ্গামাটি সরদার পাড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ১২ জনের মধ্যে ৭ জন ফেল। উত্তর রাবাইতারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ২১ জনের মধ্যে ১৩ জন ফেল।

দাশিয়াছড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ফেল ১১ জন। বটতলা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ১০ জনের মধ্যে ৫ জন ফেল। ভীমশর্মা উচ্চ বিদ্যালয় ১৪ জনের মধ্যে ১১ জন ফেল। এই বিদ্যালয়ে নিম্ন মাধ্যমিক এমপিও ভুক্ত শিক্ষক ৭ জন, স্টাফ একজন।

পঁয়ড়াডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১২ জন অংশ নিয়ে ৩ জন ফেল করে। কালিগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১৪ জন অংশ নিয়ে ৬ জন ফেল। খেলার ভিটা উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১১জন অংশ নিয়ে ২জন ফেল। কামালপুর ময়নুল হক উচ্চ বিদ্যালয় হতে ২৫ জন অংশ নিয়ে ১২ জন ফেল। চান্দেরহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় হতে ৪জন অংশ নিয়ে সবাই পাশ করে।

খামার বড়াইবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল হক শতভাগ ফেলের কথা স্বীকার করে বলেন, মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। দারিদ্র্যের কারণে ছেলে শিক্ষার্থীরা কাজের জন্য ঢাকায় চলে যায়। তা ছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি অভিভাবকদের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থী সংকট তৈরি হয়েছৈ। আর এ কারণে ফলাফল বিপর্যয় হয়েছে।

অনন্তপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, তার বিদ্যালয়ে ৯ জন শিক্ষক এবং ৫ জন স্টাফ কর্মরত থাকলেও পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে মাত্র ৪ জন। এরমধ্যে একজন ফেল করেছে।

যাত্রাপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান বলেন, তার বিদ্যালয় থেকে রেজিস্ট্রেশনকৃত সকল শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। কেননা চরাঞ্চল এবং নদী ভাঙ্গন এলাকায় হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। এতে করে পড়ালেখা ব্যহত হওয়ায় ফেলের হার বেশি।

ভীমশর্মা উচ্চ বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন ফেলের হার বেশি স্বীকার করে জানান, আমার বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক পর্যায় ৫ জন ননএমপিও শিক্ষক। তারা ২০০৪ সাল থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

খামার বড়াইবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা সবুজ আলম বলেন, এই স্কুল থেকে যে চারজন পরীক্ষা দিছে তার মধ্যে দুটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর দুজন ছেলে ঢাকায় কামলা দিয়ে এসে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। তারা কেউ নিয়মিত শিক্ষার্থী ছিল না।

একই এলাকার অভিভাবক শাহেরা বেগম বলেন, স্কুলত ঠিক মতো মাস্টাররা আসে না, ক্লাসও হয় না। তাই দুই কলম শেখানোর জন্য সন্তানদের মাদরাসায় ভর্তি করে দিছি।

দেবিচরণ গ্রামের অভিভাবক দুলাল মিয়া জানান, সুন্দরগ্রাম পুটিকাটা উচ্চ বিদ্যালয় ফেলের হার বেশি হবার জন্য শিক্ষার্থীর দোষারোপ করেন। অতিরিক্ত মোবাইল আশক্তির কারণে পড়ালেখা করেনি ছোয়ারা। তাই এবার বেশি ফেল করছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সনেট সদস্য একুশে পদকপ্রাপ্ত অ্যাড. আব্রাহাম লিংকন ফলাফল বিপর্যয়ের জন্য শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের সচেনতাকে দায়ী করেন। শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে রয়েছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার, নজরদারির অভাবে এমন ফলাফল হয়েছে বলে দাবী তার।

শিক্ষা কর্মকর্তা শামছুল আলম স্বীকার করলেন, শিক্ষকের চেয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানে এসএসসি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম রয়েছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে পড়াশোনায় জেলায় আরও বিপর্যয় ঘটার শঙ্কা প্রকাশ করেন এই কর্মকর্তা।

জেলা মাধ্যমিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কুড়িগ্রামের ৯টি উপজেলায় এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫৪৪টি। এর মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক ৩২টি, মাধ্যমিক ২৭০টি, মাদরাসা ২০৩টি, স্কুল এন্ড কলেজ ১২টি এবং কলেজ ২৭টি।

জেলা প্রাথমিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১২৪০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের তথ্যানুযায়ী কুড়িগ্রাম জেলায় ২০২২সালে এসএসসি পরিক্ষায় মোট পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল ১৯হাজার ২০৩ জন। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ হাজার ২০৩ জন। পাশ করেছে ১৪ হাজার ৪০৭ জন। ছেলে ১০ হাজার ৩০৯ জনের মধ্যে পাশ ৭ হাজার ৭৫৫ জন এবং মেয়ে ৮ হাজার ৮৯৪ জনের মধ্যে ৬ হাজার ৬৫২ জন পাশ করেছে। জেলায় গড় পাশের হার ৭৫ দশমিক শূন্য ২ ভাগ।

এছাড়াও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, কুড়িগ্রামে ২০১১ সালে আদমশুমারির তথ্যানুযায়ী ৪২দশমিক ৫ এবং ২০২২সালে ৬৪ দশমিক ৯৯ ভাগ।

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ