ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সংসার আর চলে না!

প্রকাশনার সময়: ২৭ নভেম্বর ২০২২, ০৮:৩৮

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির ঝাঁজে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। বাজারে একটি কিনলে অন্যটিতে ‘মানি সংকট’। এ যেন ‘নুন আনতে পানতা ফুরোয়’! এর সঙ্গে খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য ব্যয় তো আছেই। প্রায় সব খাতেই বাড়তি ব্যয় সামাল দেয়ার মতো আয় বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায় কমাতে হচ্ছে খাদ্য, বিনোদন ও অন্যান্য চাহিদা। করোনা মহামারির ক্ষতি ঠিকমতো পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই নিত্যপণ্যের এমন অগ্নিমূল্য সাধারণ মানুষদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

তাদের ভাষ্য, সবকিছুর মূল্যে ঊর্ধ্বগতি হওয়ার কারণে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে বাড়ি ভাড়া ও জীবনযাত্রার ব্যয় জীবনযাপনকে আরও কঠিন করে তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো কোনো পণ্যের মূল্যে নতুন করে বেড়ে যাওয়ায় অবস্থা আরও কঠিন।

রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা মজিবর রহমান বলেন, বর্তমানে দেশের অবস্থা খুব একটা যে ভালো এমন নয়। এর সঙ্গে অর্থনীতির পরিস্থিতিও মন্দা। করোনা মহামারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিও টালমাটাল। যার খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের বাজারে এসে। সবকিছুর দাম এতই বেড়েছে যে, বাজার করতে এসে হাজার পার টাকা দিয়েও ব্যাগের অর্ধেক খালি পড়ে থাকে।

তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতির পরেও আমাদের করারই বা কী আছে। ঘরে বাজার না নিলে রান্না হবে না। উল্টো বউয়ের কথা শুনতে হবে। বউ-পোলাপানের ধারে সম্মানও থাকবে না। আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নেই। বুঝতেছি না সামনে কেমনে চলব।

রাজধানীর একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র জানান, আগে মেসে সপ্তাহে এক দিন গরুর মাংস খাওয়া হতো। দাম বাড়ায় গরু কেনা বন্ধ। মুরগিও কম কেনা হয়। মাছের মধ্যে কিছুটা কম দামেরগুলো খাওয়া হয়। এভাবে বাদ দিতে দিতে খাওয়াই ছেড়ে দিতে হবে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, সরবরাহ সংকট, উৎপাদন কম হওয়া এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধি দেশের বাজার অস্থির হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার মহামারির রেশ কাটতে না কাটতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বে অর্থনীতিতে টালমাটাল অবস্থা। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নয়। দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ব্যাংকে ডলার সংকট, রিজার্ভ কমে যাওয়া, রফতানিও কমে গেছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকে এলসি খুলতেও সমস্যার মধ্যে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে নিত্যপণ্যের বাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। ক্রমেই নানা অজুহাতে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। এরমধ্যে অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার আশা সাধারণ মানুষকে আরও কাবু করে ফেলছে।

এদিকে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, মূল্য কারসাজি ঠেকাতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ সরকারের নয়টি সংস্থা মাঠে নেমেছে। যার নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক (খাদ্যের বিশুদ্ধতা পরিবীক্ষণ ও বিচারিক কার্যক্রম) ড. সহদেব চন্দ্র সাহা।

জানা যায়, মুদি দোকানসহ নিত্যপণ্য বিক্রয়কারী পাইকারি ও খুচরা প্রতিষ্ঠান, কারখানা ও হোটেল-রেস্টুরেন্ট, শিশুখাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে যারা অনিয়ম করছে তাদের টার্গেট করে সমন্বিতভাবে কাজ শুরু করেছে।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মনিটরিং অফিসার ইমরান হোসেন মোল্লা বলেন, আপাতত প্রতি মাসে একবার এই নয়টি সরকারি সংস্থার সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করা হবে। প্রয়োজন হলে একাধিকবার অভিযান চালানো হবে। এর বাইরেও প্রতিটি সংস্থা নিজ নিজ কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

পর্যবেক্ষণ বলছে, বাজারে একটি পণ্য দুই সপ্তাহে আগে যে মূল্য থাকে দুই সপ্তাহ পরে সে পণ্যের মূল্যে থাকে ভিন্ন দাম। সব পণ্যের কমবেশি বাড়তি দামে বাজারে গিয়ে দোকানদারদের সঙ্গে একপ্রকার বাকবিতণ্ডা সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও দোকানদারের গলার ভিন্ন সূর। দোকানদার দুষছেন পাইকারি ব্যবসায়ীদের আর ব্যবসায়ীরা দুষছেন ডিলারদের। তাদের এই তিন হাত বদল পণ্য ক্রয়ে অনেকটাই সাধারণ মানুষদের কাছে গলা টিপে টাকা নেয়ার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মোহাম্মদপুরের খুচরা পাইকারি ব্যবসায়ী সালমান বলেন, দাম বাড়ার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো হাত নেই। ডিলার থেকে যে দামে মাল আসছে আমরা স্বল্প লাভে সেইগুলো বিক্রি করছি। যদি দোকানদাররা এসে আমাদের সঙ্গে দাম বেশি নিয়ে ঝগড়া করে। আমরা ডিলারদের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কথা বলতে গেলে তারা নানা অজুহাত দেখায়। কিন্তু, আমরা অজুহাত দেখাব কাদের কাছে। দাম বৃদ্ধি নিয়ে মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানেও আমাদের জরিমানা করে। ডিলার আর দোকানদের চিপায় পড়ে আমরা অনেকটাই নাজেহাল।

নানা সময় নানা কারণে দেশের নিত্যপণ্যে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করে মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। কিন্তু, সরকারে নির্ধারণ করে দেয়া মূল্যের চেয়েও অতি মুনাফার আশায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফার আশায় তা বেশি দামে বিক্রি করে। যদিও এ ব্যাপারে সরকারের একাধিক সংস্থা বাজার নিয়ন্ত্রণ, মজুদদারদের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করলেও বাজারে এর প্রভাব খুব একটা পড়ে না। বরং কঠোর অভিযান শুরু হলেও সরকারের বেঁধে দেয়া দামে পণ্য কেনা তো যায় না, বরং পণ্য সরিয়ে ফেলেন ব্যবসায়ীরা। তাই বাড়তি দাম মেটাতে গিয়ে ব্যয় সংকোচন নীতির দিকে হাঁটছেন বেশিরভাগ মানুষ।

তবে বাজার বিশ্লেষকরা এই ধরনের অভিযান জোরদার করার তাগিদ দিচ্ছেন। অন্যথায়, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। যদিও অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভোক্তা অধিকার আইনের জরিমানা বাড়াতে আইন সংশোধন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, বিদ্যমান আইনে জরিমানা অপরাধ অনুযায়ী যথেষ্ট নয়। তাই আইনের সংশোধন প্রয়োজন। ওই আইনে যে জরিমানা ও শাস্তি রয়েছে তা দ্বিগুণ করা হচ্ছে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ