টালমাটাল অর্থনীতিতে দুঃসংবাদ আরও বাড়ল। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে আপাতত এর কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানানো হলেও শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা। এই দাম বৃদ্ধির ফলে ফের সবকিছুর দাম বাড়বে বলে তাদের শঙ্কা। সব কিছুতে দাম বাড়লে পোশাকশিল্পে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, মানুষের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে পোশাক খাত গভীর সংকটে পড়বে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরায় আমদানি কমছে। পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। এক ধরনের স্বস্তি বোধ করছে সরকার। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কাঁচামাল আমদানি করতে না পারলে উৎপাদন কমে যাবে। এভাবে আমদানি লাগাম টানা অর্থনীতির জন্য মোটেও সুখবর নয়।
রেমিট্যান্সেও নেই কোনো সুখবর। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই খাত এখন নেতিবাচক ধারায় চলছে। প্রতিমাসেই কমছে রেমিট্যান্স। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মতো চলতি নভেম্বর মাসেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত। ফলে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে কমায় বেশ অস্বস্তিতে আছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি মাসের রেমিট্যান্স প্রবাহের ১৮ দিনের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, নভেম্বর মাসের প্রথম ১৮ দিনে ১০৬ কোটি (১.০৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৫ কোটি ৮৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে প্রতিদিন গড়ে ৭ কোটি ডলার করে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
চলতি মাসের বাকি ১২ দিনে এই হারে রেমিট্যান্স এলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মতো নভেম্বর মাসেও দেড় বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি রেমিট্যান্স আসবে। গত বছরের নভেম্বর মাসে ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। জুলাইয়ে এসেছিল ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার; যা ছিল আগের ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে বেশি ছিল ১২ শতাংশ। আগস্টে আসে ২ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। ওই দুই মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ছিল ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা ছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ১৭২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার এসেছিল। পরের মাস অক্টোবরে এসেছিল ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। এ মাসে ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ (১.৫২ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত আট মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
গত বছরের অক্টোবরে ১৬৪ কোটি ৬৯ লাখ (১.৬৪ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল। আগের মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৫৪ কোটি ডলার। এ হিসাবে গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে এই অক্টোবরে ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ রেমিট্যান্স কম এসেছে। আর সেপ্টেম্বরের চেয়ে কম এসেছে ১ শতাংশের মতো। গত ফেব্রুয়ারিতে ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ (১.৪৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এর আট মাস পর সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স আসে অক্টোবরে।
তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানির জন্য ২ হাজার ৪২৭ কোটি (২৪.২৭ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩১ কোটি ডলার বা ১৫ শতাংশ কম। গত বছরের এই চার মাসে ২ হাজার ৮৫৮ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। তবে জুলাই-অক্টোবর সময়ে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
বর্তমান অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমদানি কমাকে দেশের অর্থনীতির জন্য ‘মঙ্গল’ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। তারা বলেছেন, এই মুহূর্তে এটারই খুব দরকার ছিল। আমদানি কমলে ডলারের বাজারও স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
আমদানি কমায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশের উত্তরণবিষয়ক জাতীয় সেমিনারে গভর্নর বলেন, ‘আড়াই বছরের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের অর্থনীতিও চাপে পড়েছিল। আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। যার ফলে রিজার্ভ কমে গেছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আমদানি বেশ কমেছে। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের পরিমাণ আমদানির তুলনায় বেশি হওয়ায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে দেশে ডলারের কোনো সংকট থাকবে না। রিজার্ভও বাড়বে।’
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘নতুন এলসি খোলা যেটা কমেছে সেটার প্রভাব দেখতে পাওয়া আরও কয়েক মাস পরে। ২০২৩ সালের প্রথম দিকে সেটা কমে আসবে। এখন যেসব এলসি নিষ্পত্তি হচ্ছে সেগুলো ছয় মাস বা এক বছর আগের খোলা ডেফার্ড এলসি। যার ফলে ব্যয় বাড়ছে। এতে ব্যাংকগুলোতে বেশি চাপ পড়ছে, যা আগামী দুই-তিন মাস অব্যাহত থাকবে। আশা করা যায়, নতুন বছরের শুরু থেকেই আমদানি খরচ আরও কমে আসবে। ডলারের বাজারও স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’
পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর নানা শঙ্কার কথা জানান তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট বেড়েছে। বাড়তি দামেও আমরা বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালাচ্ছি। ফলে উৎপাদন খরচে দিন দিন বাড়ছে। তিনি বলেন, এখন নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে আমাদের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে বিশ্ব বাজারের প্রতিযোগিতায় আমাদের টিকে থাকা কষ্টকর হবে। পাশাপাশি জিনিসপত্রের দাম হু হু করে আরও বাড়বে। জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হবে।
জুলাই থেকে পোশাকের অর্ডার ও দাম কমছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে বিশ্ব বাজারে আমাদের বড় ধরনের সমস্যা হবে। আমরা অর্ডার হারাতে চাই না। ব্যবসার স্বার্থে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
পাওয়ার গ্রিড, তিতাস বিদ্যুৎ ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিগুলোকে অবৈধ লাইন কেটে দেয়ার পাশাপাশি মিটারের কারসাজি বন্ধ করার আহ্বান জানান বিজিএমইএ সভাপতি। তাতে সরকারের অনেক বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে এবং অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যুক্ত হবে বলে মনে করেন তিনি।
পোশাক মালিকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১ টাকা ৩ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। খুচরা পর্যায়ে না বাড়ালেও বাজারে এর প্রভাব পড়বে। তাই সরকারকে অনুরোধ করব খুচরা পর্যায়ে যাতে না বাড়ানো হয়। তিনি বলেন, যদি খুচরা পর্যায়ে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। তবে উৎপাদন খরচ বাড়বে। তাতে বর্তমানে কারখানাগুলো যে বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছে, আগামীতে এটাও দিতে পারবে না। কারণ এমনিতেই বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য সংকটে রয়েছি।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ