একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান। বসবাস করেন রমনা থানাধীন ইস্কাটন এলাকার একটি ফ্ল্যাটে। সম্প্রতি রাত ৮টার দিকে তার মোবাইল ফোনে +১৬২৩৩, ০১৬১৩-৯৮০২২৫ নম্বর থেকে একটি ফোন আসে। ফোনকারী ব্যক্তি নিজেকে স্টান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের কর্মকর্তা পরিচয় দেন। এরপর তার হিসাব নাম্বারের সিস্টেম আপডেটের সমস্যার কথা বলে ক্রেডিট কার্ডের বিভিন্ন গোপন তথ্য জানতে চান। এরপর তিনি বিশ্বাস করে গোপন তথ্য সরবরাহ করেন। এক পর্যায়ে তার ব্যবহূত মোবাইল ফোনে একটি ওটিপি নম্বর এলে সেটি ফোনকারী ব্যক্তিকে জানিয়ে দেন। এরপর তিন ধাপে তার অ্যাকাউন্ট থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে যাওয়া হয় ৩টি বিকাশ নম্বরে।
একপর্যায়ে হাসান বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এরপর কার্ডের লেনদেন বন্ধ করার জন্য ব্যাংকের হটলাইন নম্বরে ফোন করার চেষ্টা করলে হ্যাকাররা তাদের ব্যবহূত +১৬২৩৩ ও ০১৬১৩-৯৮০২২৫ নম্বর থেকে হাসানের নম্বরে কল করে ব্যস্ত রাখে। এ ঘটনায় তিনি রমনা থানায় মামলা করেন। শুধু হাসানই নয়, এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা অহরহই ঘটছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও কোথাও মামলা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসে গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া এ ধরনের ৫টি মামলার নিয়ে মাঠে নামেন গোয়েন্দারা। এক পর্যায়ে তারা ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকায় একটি চক্রের সন্ধান পায়। ওই চক্রের নেতৃত্বে রয়েছেন রেজাউল মাতুব্বর। তিনি একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। ওই চেয়ারম্যানসহ আরও ৩ জনকে শনাক্ত করা হয়।
সূত্রমতে, ওই চক্রের প্রায় সবাইকেই গোয়েন্দা জালে রাখা হয়েছে। দু’এক দিনের মধ্যে তাদের গ্রেফতারের পর সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানানো হবে। চেয়ারম্যান রেজাউল মাতুব্বর ও তার বন্ধু দিদার মুন্সি এই ক্রেডিট কার্ড প্রতারণা চক্রের মূলহোতা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে পুরো ইউনিয়ন ও পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের ক্রেডিট কার্ড প্রতারণার নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। দিদারের নামে ফরিদপুরে প্রতারণা ও ডিজিটাল আইনে ২টি মামলা রয়েছে। চক্রের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন— একই ইউনিয়নের দেয়া গ্রামের নাঈম হোসেন ও মিয়াপাড়া গ্রামের জাহিদুল। এদের মধ্যে নাঈমের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ ঘটনার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংকে কর্মরতদের যোগসাজশ রয়েছে। তারাই ক্রেডিট কার্ডের তথ্য দিয়ে হ্যাকারদের সহযোগিতা করছেন। এ কারণে নিশ্চিত না হয়ে ক্রেডিট কার্ডের গোপন তথ্য সরবরাহ না করার অনুরোধ করেছেন গোয়েন্দারা।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন-অর-রশিদ জানান, এ ধরনের একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। যারা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড হ্যাক করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ধরনের একটি চক্রকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে দ্রুতই তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এদের বেশিরভাগেরই বাড়ি ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকায়। পাশাপাশি এই চক্রের সঙ্গে ব্যাংকের কোনো ব্যক্তি জড়িত কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সূত্রমতে, ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকার বিভিন্ন ইউনিয়নে এ ধরনের প্রতারক চক্রের সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে। তারা আগে বিকাশের নামে প্রতারণা করলেও সম্প্রতি তারা ক্রেডিট কার্ডের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। একের পর এক ক্রেডিট কার্ড হোল্ডারদের অ্যাকাউন্টের তথ্য নিয়ে তাদের নিজেদের ব্যাংকের লোক পরিচয় দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সাধারণ জনগণকে ধোঁকা দিতে তারা ব্যাংকের হেল্পলাইনের বিভিন্ন নম্বর ক্লোন করে ব্যবহার করেছে প্রতারণার কাজে। এ ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) কার্ডধারী আবু বক্কর সিদ্দিক। এ ঘটনায় তিনি চলতি বছরের মে মাসের শেষের দিকে ডেমরা থানায় মামলা দায়ের করেন। তিনি প্রতারণার শিকার হন চলতি বছরের মার্চ মাসে।
মামলায় বলা হয়, ‘গত ১২ মার্চ দুপুর আনুমানিক দেড়টার দিকে +১৬৪৯১ থেকে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একটি কল আসে। এ সময় ফোনকারী ব্যক্তি নিজেকে ব্যাংকের কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে আবু বক্করের কার্ডে সমস্যা হয়েছে বলে জানান। একই সঙ্গে তারা নাম ও বাড়ির ঠিকানা, কার্ডের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখসহ যাবতীয় তথ্য দেন তাকে। এতে আবু বক্করের বিশ্বাস হয়। এরপর ফোনকারীকে ওটিপি নম্বর বলে দেন। এই সুযোগে হ্যাকার তার ক্রেডিট কার্ড নং-৪৩৫৯৫৬৫৩০০৩১২১২ থেকে একটি নগদ নম্বরে ১০ হাজার টাকা সেন্ডমানি করেন। এক পর্যায়ে তিনি প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পেরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে প্রতারণার বিষয়টি জানালে তিনি মে মাসের শেষের দিকে থানায় মামলা করেন।
একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে কদমতলী থানায় মামলা দায়ের করেন সুমাইয়ার বিনতে আবদুর রব। তার কাছ থেকেও হাতিয়ে নেয়া হয় ২০ হাজার ৮০০ টাকা। ৬১ হাজার ৭০০ টাকা খুইয়ে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন জাহিদ হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী। তাকেও একইভাবে বোকা বানানো হয়। একই ধরনের ঘটনায় তেজগাঁও থানায় জাহিদুর রহমান আকন্দ নামে অপর এক ব্যক্তি মামলা করেন। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি তার মোবাইল ফোন নাম্বারে +১৬৩২ থেকে একটি কল আসে। ফোনের অপরপ্রান্তের ব্যক্তি এ সময় নিজেকে লঙ্কাবাংলা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কল করছেন বলে জানায় এবং আমার কাছে থাকা ক্রেডিট কার্ড (নং- ৫৩০৫০৫০১৫৫৫৯৩৫০৮) এর পাসওয়ার্ড আপডেট করতে হবে বলে জানায়। কল করে তিনি বলেন ওই ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আপডেট করা যাবে অথবা তাকে চাহিত মোতাবেক তথ্য দিলে সে ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড আপডেট করে দিতে পারবে বলে জানায়। ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড আপডেট করার মতো সময় না থাকায় জাহিদুর তাকে ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড আপডেট দিয়ে দিতে বলেন।
এ সময় ফোনকারী ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড আপডেট দেয়ার সময় বিভিন্ন তথ্য ও ক্রেডিট কার্ডের পেছনের সিভিভি কোড নম্বর চায়। জাহিদুর তাকে তথ্য ও ক্রেডিট কার্ডের সিভিভি কোড নম্বর দিয়ে দেন। এরপর তার ওই কার্ড থেকে ৩০ হাজার করে সাত বার ট্রানজেকশন হয়। প্রতি বারে ত্রিশ হাজার টাকা করে সর্বমোট দুই লাখ দশ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রের সদস্যরা। তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসান জানান, ‘এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি সঙ্গে সঙ্গে ডিবির সাইবার ক্রাইম ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। তারা এই মামলার তদন্ত করছে।’
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ