ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

রফতানি আয়ে ধস

প্রকাশনার সময়: ০৩ নভেম্বর ২০২২, ০৯:০৩

প্রবাসী আয়ে যে থাক্কা লাগল— তার রেস এসে পড়ল রফতানি আয়ের ওপরও। ডলার সংকটের এই সময়ে প্রবাসী আয়ের পথেই হাঁটল রফতানি আয়। গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় চলতি বছরের অক্টোবরে রফতানি আয় কমেছে। চলতি বছরের অক্টোবরে ৪৩৫ কোটি ৬৬ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলারের পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি হয়েছে। যা ২০২১ সালের অক্টোবরে ছিল ৪৭২ কোটি ৭৫ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার।

সে হিসাবে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের তুলনায় ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ৩৭ কোটি ৯ লাখ ১০ হাজার ডলার রফতানি আয় কমেছে। যা শতাংশের হিসাবে ৭.৮৫ শতাংশ। গতকাল বুধবার রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে সরকারে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ১২.৮৭ শতাংশ রফতানি আয় কমেছে ২০২২ সালের অক্টোবরে। এই মাসে রফতানি আয় খাতে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। সেখানে রফতানি হয়েছে মাত্র ৪৩৫ কোটি ৬৬ লাখ ২০ হাজার ইউএস ডলারের। অর্থাৎ ৬৪ কোটি ৩৩ লাখ ৮০ হাজার ডলার কম হয়েছে। যা শতাংশের হিসাবে প্রায় ১৩ শতাংশ।

এর ফলে ১৩ মাস টানা রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধির পর চলতি বছরের সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর টানা দুই মাস তার আগের বছরের তুলনায় রফতানি আয় কমলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় কমতে শুরু করেছে বাংলাদেশের রফতানি আয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়েছে। এ কারণে তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। খাদ্যের পেছনেই অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে তাদের। সে কারণে বাংলাদেশের রফতানি আয় কমছে।

অবশ্য তৈরি পোশাক মালিকসহ অন্য ব্যবসায়ীরা আগেই শঙ্কা প্রকাশ করছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজার থেকে ক্রয় আদেশ কমে যাবে। ফলে দেশের রফতানি আয়ও কমে আসবে।

ইপিবির তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই থেকে অক্টোবর) বিশ্ববাজারে দেশের পণ্য রফতানি হয়েছে ১ হাজার ৬৮৫ কোটি ৩৫ লাখ ১০ হাজার ইউএস ডলারের। এই চার মাসে সরকারের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৭৪২ কোটি ইউএস ডলার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫৬ কোটি ৬৪ লাখ ৯০ হাজার ইউএস ডলার বা ৩.২৫ শতাংশ কম হয়েছে।

তবে একটু এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের একই সময়ে সঙ্গে তুলনা করলে এখনো রফতানি আয়ের হার পজিটিভ রয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর সময় পর্যন্ত রফতানি আয় হয়েছিল ১ হাজার ৫৭৪ কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ইউএস ডলার। সে হিসাবে গত বছরের তুলনায় এখনো ৭.১ শতাংশ রফতানি আয়ে বেড়েছে। ইপিএসের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম রফতানি আয়ে হোঁচট খায় বাংলাদেশ। সেই মাসে বাংলাদেশ ৩৯০ কোটি ৫০ লাখ (৩.৯০ বিলিয়ন) ৭ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি করেছিল। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪১৬ কোটি ৫৪ লাখ ৫ ডলারের পণ্য।

একক মাসে হিসেবে সেপ্টেম্বর মাসে রফতানি আয় কমেছে। কিন্তু আগের দুই মাস জুলাই-আগস্টে আয় বেড়েছিল। সব মিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ১ হাজার ২৪৯ কোটি ৬৮ লাখ ৯ হাজার ডলারের পণ্য বিদেশে রফতানি করেছে বাংলাদেশ।

২০২১ সালের প্রথম তিন মাসের রফতানি আয় ছিল এক হাজার ১০২ কোটি ১৯ লাখ ৫ হাজার ডলার। সেই তুলনায় তুলনায় ২০২২ সালের একই সময়ে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩.৩৮ শতাংশ।

এদিকে, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক কমায় রিজার্ভ নেমেছে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে। বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫.৭৯ বিলিয়ন ডলার। আগামী সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১.৫ বিলিয়ন ডলারের মতো আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ নেমে আসবে ৩৪.৩০ বিলিয়ন ডলারে।

গত বছরের আগস্টে এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। এক বছর আগে ২৭ অক্টোবর রিজার্ভ ছিল ৪৬.৫০ বিলিয়ন ডলার।

তবে রিজার্ভের এই হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তারা বেশ কিছুদিন ধরেই বলে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের যে তথ্য প্রকাশ করছে, তা থেকে প্রকৃত রিজার্ভ ৮ বিলিয়ন ডলার কম।

সংকট মোকবিলায় সরকার আইএমএফের কাছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ চেয়েছে, তা নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনার জন্য আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল এখন ঢাকায়। ইতোমধ্যে গভর্নরসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও করছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। বৈঠকে রিজার্ভের হিসাবায়নে মোট রিজার্ভ ও প্রকৃত রিজার্ভকে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করার কথা বলা হয়। রিজার্ভ থেকে কোন কোন বিনিয়োগকে বাদ দিয়ে প্রকৃত রিজার্ভ হিসাব করতে হবে, তাও আবার স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব নিয়ে। আইএমএফ বলছে, ভুল শ্রেণিকরণের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের আকার বড় হয়েছে বলে দাবি করে আইএমএফ।

২০২১ সালে আইএমএফ বলেছিল, চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে বাংলাদেশে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ থাকার যে কথা বলা হয়েছিল, তা আসলে ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে বলা হয়েছে। রিজার্ভ-বহির্ভূত সম্পদ অন্তর্ভুক্ত করে রিজার্ভ ৭.২ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এবার ঋণ নিয়ে আলোচনা করতে এসে আইএমএফ কর্মকর্তারা বেশ জোরালোভাবেই এ বিষয়টি তুলে ধরে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের শর্ত হিসাবেই যুক্ত করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এতে সম্মত হয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে এখন থেকে আইএমএফের কাছে তথ্য পাঠানোর সময় প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য পাঠানো হবে।

এক বছর আগেও দেশে রিজার্ভ ছিল ৪,৮০০ কোটি ডলারের (৪৮ বিলিয়ন) বেশি। আমদানি খরচ বাড়ায় যা এখন কমে হয়েছে ৩,৫৮৫ কোটি (৩৫.৮৫ বিলিয়ন) ডলার। রিজার্ভ থেকে ৭ বিলিয়ন দিয়ে গঠন করা হয়েছে রফতানিকারকদের জন্য রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ)।

আবার রিজার্ভের অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছে লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ) ও গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)। বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়া হয়েছে। আবার পায়রাবন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতেও রিজার্ভ থেকে অর্থ দেয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দেয়া হয়েছে। এসব খাতে সব মিলিয়ে ব্যবহূত হয়েছে ৮ বিলিয়ন ডলার।

আইএমএফ বলছে, এসব বিনিয়োগকে বাদ দিয়ে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব করতে হবে। কারণ রিজার্ভের এসব অর্থ চাইলেই ফেরত পাওয়া যাবে না। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে না। আইএমএফের শর্ত মানলে বর্তমানে রিজার্ভ কমে হয় ২৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। আর চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১.৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর তা নেমে আসবে ২৫.৫ বিলিয়ন ডলারে। সেপ্টেম্বরে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। সেই হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী একটি দেশের কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ রিজার্ভ থাকতে হয়। সে বিবেচনায় বেশ অস্বস্তিতে আছে বাংলাদেশ।

তবে আশার কথা, ডিসেম্বরের মধ্যে আইএমএফের ঋণের সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তির দেড় বিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ঋণ পাওয়া গেলে সংকট কিছুটা হলেও কেটে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান এইচ মনসুর।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, ‘আইএমএফের মূল কাজ হচ্ছে ক্রাইসিস ঠেকানো। সংস্থাটির এই ঋণ একটি আস্থার সৃষ্টি করবে। বিশ্বব্যাংক তখন পাশে থাকবে। তারা ১.৫ বিলিয়ন ডলার কম সুদের যে ঋণ দিতে চাচ্ছে, সেটা দ্রুত দিয়ে দেবে।

তিনি বলেন, এডিবি এগিয়ে আসবে। জাইকা আসবে। সবাই এগিয়ে আসবে। তখন তারা সবাই তাদের সাপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসবে। রিজার্ভ বাড়বে; সরকার সাহস পাবে। আর সেই সাহসের ওপর ভর করে করোনা মহামারির মতো এই সংকটও মোকাবিলা করতে পারবে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ