ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

তবুও আশাবাদী এনবিআর

প্রকাশনার সময়: ২৫ অক্টোবর ২০২২, ০৯:০০

হঠাৎ করেই রাজস্ব আয়ে ছন্দপতন ঘটেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রাজস্ব আয় উর্ধ্বমূখী হলেও তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসে ছন্দপতন হয়। প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আদায়ে গতি কমে যায়। তবে ছন্দপতনের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আশাবাদী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআরের কর্তারা বলছেন, প্রথমার্ধে রাজস্ব আদায়ের গতি নিচের দিকে থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে ব্যবসা-বাণিজ্য আবারও গতি পাবে। তখন রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।

এনবিআরের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬.৭৫ শতাংশ। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৫.৭৫ শতাংশ। যদিও চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে অর্থাৎ জুলাই-আগস্টে রাজস্ব আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এদিকে আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আমদানি কমে আসায় রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট আহরণে তার প্রভাব পড়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণে ছন্দপতন ঘটেছে।

এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলত বিলাসী পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করার পর থেকেই রাজস্ব আয় কমতে শুরু করেছে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ কেনাকাটা কমিয়েছে। ফলে রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় খাত ভ্যাট থেকে উল্লেখযোগ্য আয় আসেনি। বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। গত আগস্টে সেটি ৯.৫২ শতাংশে পৌঁছেছিল।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৭ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৫৮ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৫.৭৫ শতাংশ।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে সরকারের মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এনবিআরের শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। এ সময়ে এনবিআর আদায় করেছে ৬৭ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। এই তিন মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৭১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা।

এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, বৈশ্বিক মন্দার পূর্বাভাসের কারণে দেশের অভ্যন্তরে অর্থনীতির কিছুটা শ্লথগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। এনবিআর কর্মকর্তারা অবশ্য আশা করেন, দ্বিতীয়ার্ধে ব্যবসা-বাণিজ্য আবারও গতি পাবে। তখন রাজস্ব আদায়ও বাড়বে। আমদানি, ভ্যাট ও আয়কর- এই তিন উৎস থেকে রাজস্ব আহরণ করে এনবিআর। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান ভ্যাটের। মোট রাজস্বের ৩৯ শতাংশ আসে ভ্যাট থেকে। আয়কর থেকে আসে ৩৭ শতাংশ। বাকি রাজস্ব আসে আমদানি শুল্ক থেকে।

এনবিআর তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট সবচেয়ে বেশি আদায় হয়েছে। এ খাতে আদায় ২৪ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। এই খাতে ঘাটতি হয়েছে ৯৬ কোটি টাকা। এরপর আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর আদায় হয়েছে ২২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। এ খাতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। আয়কর খাতে আদায় হয়েছে ২০ হাজার ১০২ কোটি টাকা। এ খাতে লক্ষ্যের চেয়ে ১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা পিছিয়ে আছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজস্ব আয়ে এবার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জন করতে হলে আদায় বাড়াতে হবে কমপক্ষে ৩১ শতাংশ। যদিও এনবিআরের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, রাজস্ব আয়ের চলমান ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে।

সরকার বাজেট বাস্তবায়নে যে অর্থায়ন করে তার ৮৫ থেকে ৮৬ শতাংশ জোগান দেয় এনবিআর। আর রাজস্ব আয় ভালো হলে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ সহনীয় থাকে। এতে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারেন। তাতে অর্থনীতি গতিশীল হয়।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজস্ব আদায় কমে গেলে সরকার ব্যাংক থেকে বা দেশের বাইরে থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। আমাদের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী রাজস্ব আয় সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই রাজস্ব আয় আরও বাড়াতে হবে। এই মুহূর্তে রাজস্ব বাড়াতে বিশেষ তৎপরতা চালাতে হবে।

রাজস্ব বোর্ডের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি শুল্ক খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬.৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে শুল্ক খাতে আদায় হয়েছে ২২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের এই সময়ে আদায় ছিল ১৯ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা।

এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ভ্যাটে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬.৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ এই তিন মাসে ভ্যাট আদায় হয়েছে ২৪ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এই সময়ে ভ্যাট আদায় হয় ২১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা।

আয়কর খাতে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১৩.৮২ শতাংশ। এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আয়কর থেকে আদায় হয়েছে ২০ হাজার ১০২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই খাতে আদায় হয় ১৭ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা।

এদিকে সেপ্টেম্বর মাসেও রাজস্ব আদায়ে সামান্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই মাসে সর্বমোট ২৬ হাজার ৮৩৩ রাজস্ব আদায় হয়েছে; যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ৭.৬৭ শতাংশ বেশি।

গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে ২৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকার রাজস্ব। গত বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮৩২ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৭ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।

সেপ্টেম্বর মাসে আমদানি শুল্ক আদায় হয়েছে ৭ হাজার ৫৯১ কোটি টাকার যা গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ১.৪৭ শতাংশ কম আর চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা কম। সেপ্টেম্বরে ৯ হাজার ৫১৩ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় হয়েছে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আদায় হয়েছে ১,২৯৯ কোটি টাকা। এই আয় গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ১৭.৪ শতাংশ বেশি।

অন্যদিকে আয়কর থেকে পাওয়া আয় লক্ষ্যমাত্রা ও গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি। সেপ্টেম্বরে আয়কর থেকে আয় হয়েছে ৯ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২৫ কোটি টাকা বেশি। আর গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.০৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে আয়কর থেকে আদায় হয়েছিল ৯ হাজার ৮৯ কোটি টাকা।

গত দুই বছর করোনার কারণে আয়কর মেলা হয়নি। এবারও আয়কর মেলা হচ্ছে না জানিয়েছে এনবিআর। তবে মেলা না হলেও কর কার্যালয়ে রিটার্ন দেয়ার সুবিধা নিশ্চিত করতে নভেম্বর মাসজুড়ে সেবা মাস পালন করা হবে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ