ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ধার নেয়া বাড়িয়েছে ব্যাংক

প্রকাশনার সময়: ২৪ অক্টোবর ২০২২, ০৯:০৮

তারল্য সংকটে দেশের ব্যাংকগুলো। নগদ অর্থের প্রবাহ ঠিক রাখতে ব্যাংকগুলো কলমানিতে ঝুঁকছে। কিন্তু তারল্য সংকটের কারণে ‘শর্ট নোটিশে’ ধার করা বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলোতে তিন ও সাত দিনের জন্য অন্য ব্যাংক থেকে শর্ট নোটিশে আগের চেয়ে টাকা ধার করা বেড়েছে। এ জন্য বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে তাদের। কলমানিতে সুদের হার যেখানে ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। শর্ট নোটিশে ধার করা সুদের হার সেখানে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তা বলেন, কয়েক মাস ধরে ব্যাংকগুলোতে এক রকমের তারল্য চাপের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ সময়ে ওভারনাইটের চেয়ে শর্ট নোটিশে টাকা ধার নেয়া বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র বলছে, ওভারনাইট (এক দিনের জন্য) ঋণের চেয়ে শর্ট নোটিশে টাকা ধার করার দিকে বেশি ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে এক দিনের মধ্যে টাকা ধার দেয়া থেকে শর্ট নোটিশে টাকা দিলে বেশি সুদ পাওয়া যায়, ফলে ব্যাংকগুলোও শর্ট নোটিশে টাকা ধার দিতে বেশি আগ্রহী।

আবার শর্ট নোটিশে টাকা ধার নেয়ার সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। চলতি বছর সেপ্টেম্বরের প্রথম সাত দিনে শর্ট নোটিশের গড় সুদ ছিল সর্বনিম্ন ৭ দশমিক ০১ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অক্টোবরের ১৫ দিনে এটির গড় দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছর জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসের চেয়ে প্রতি কার্যদিবসে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে শর্ট নোটিশের সুদের হার বেড়েছে।

জুনে সাত দিনের শর্ট নোটিশে ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ থেকে ৬ দশমিকের আশপাশের মধ্যে ছিল। জুলাইতে এটি ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশের ওপর চলে যায়।

আগস্টেও প্রতি কার্যদিবসে শর্ট নোটিশে ৭ শতাংশের ওপর সুদের হার ছিল। সেপ্টেম্বরে বেশিরভাগ কর্মদিবসে এটির হার ৭ দশমিক ২০ শতাংশ ছাড়ায়। অক্টোবরের ১১ দিনে শর্ট নোটিশে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশের ওপর সুদে টাকা ধার নিয়েছে ব্যাংকগুলো।

ট্রেজারি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রতিদিন ডলার বিক্রি করার কারণে বাজার থেকে তারল্যের সংকট তৈরি হয়েছে। ডলার বিক্রি করায় টাকা চলে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। সে সঙ্গে বেসরকারি খাতে বেড়েছে ঋণপ্রবাহ। অন্যদিকে ব্যাংকে আমানতের পরিমাণও কমেছে। সব মিলিয়ে নগদ টাকার সংকট ব্যাংকে।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকে পর্যাপ্ত পরিমাণে তারল্য না থাকায় কলমানিতে টাকা নেয়া বাড়বে, তবে কলমানিতে টাকা না থাকলে ব্যাংক তখন শর্ট নোটিশে টাকা ধার করে। গত কয়েক মাস ধরে শর্ট নোটিশের সুদের হার বেড়েছে। ফলে বোঝা যায়, ব্যাংকগুলো তারল্য চাপের মধ্যে আছে এবং কলমানিতে টাকা না পেয়ে শর্ট নোটিশে ধার নিচ্ছে।

তিনি বলেন, আমানত কমে যাওয়া, বেসরকারি খাতে রেকর্ড পরিমাণে ঋণ দেয়া ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অধিক টাকা চলে যাওয়ার জন্য এ সংকটের মধ্যে পড়ছে ব্যাংকগুলো। তবে এই চাপ কমে এলে কলমানি এবং শর্ট নোটিশের সুদের হার কমে আসবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছর অক্টোবর মাসে ৭ দিনের শর্ট নোটিশে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ধার করেছে ব্যাংকগুলো। গত ছয় মাসের মধ্যে কোনো দিন এ গড় এক হাজার কোটি পার হয়নি।

চলতি বছরের জুনে প্রতি কার্যদিবসে শর্ট নোটিশে বেশিরভাগ সময় ১৪০ কোটি টাকা থেকে শুরু করে ৪৫০ কোটি টাকার লেনদেন করে ব্যাংকগুলো। যদিও এ সময়ে কয়েক বার ৭০০ কোটি টাকার ওপর লেনদেন হয়। জুন শেষে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ৩৬০ কোটি টাকার ওপর লেনদেন হয়।

জুলাইতে ৭ দিনের কর্মদিবসে শর্ট নোটিশে লেনদেন করা আরও বেড়ে যায়। এ মাসে ১৫ দিনের ওপর প্রতি কার্যদিবসে ৩৫০ কোটি টাকা থেকে ৬৫০ কোটি টাকার ওপর ধার নেয় ব্যাংকগুলো। একাধিকবার ১ হাজার কোটি টাকার ওপর ধার নেয়া হয়। জুনে প্রতি কার্যদিবসে ৬০০ কোটি টাকার ওপর ৭ দিনের শর্ট নোটিশে ধার নেয় ব্যাংকগুলো।

আগস্টে এই গড় হার জুলাই থেকে আরও ১০০ কোটি টাকা বেড়ে যায়। এ সময়ে ১৪ বারের বেশি ৪০০ কোটির ওপর ধার নেয় ব্যাংকগুলো। ১ হাজার কোটি টাকার ওপর ধার নেয় একাধিকবার। আগস্ট মাসের প্রতি কার্যদিবসে ধার নেয়ার হার ৬৯০ কোটি টাকার ওপর।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে টাকা ধার দিয়েছে। সেপ্টেম্বরের আগের মাসগুলোতে শর্ট নোটিশে সুদের হার আরও কম ছিল।

ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, তারল্য চাপে পড়লে সাধারণত একটি ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে টাকা সংগ্রহ করে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও টাকা সংগ্রহ করতে পারে।

অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘কলমানি থেকে ব্যাংকগুলো টাকা ধার নেয়া বাড়িয়ে দিলে এবং সুদের হার বেড়ে গেলে বোঝা যায় যে, ব্যাংক তারল্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া ওভারনাইটের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো রেপো রেট ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশের বেশি চার্জ করতে পারে না। তাই বাজারে তারল্য চাপ বেড়েছে কিনা সেটি বোঝার অন্যতম টুল হিসেবে ৩ ও ৭ দিনের জন্য শর্ট নোটিশে টাকা ধার করার সুদের হার পর্যালোচনার মাধ্যমে উঠে আসে। কয়েক মাসের এই হার বিবেচনা করলে দেখা যায়, এই হারটি ক্রমাগত বাড়ছে। অর্থাৎ বাজারে এক রকমের তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।

তিন ও সাত দিনের শর্ট নোটিশে টাকা ধার করার বিষয়টির কারণ হিসেবে দুইটি ব্যাখ্যা বলছে একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলোতে তারল্য চাপ তৈরি হলে ওভারনাইট কলমানিতে চাহিদা বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলো একটি নেগোসিয়েশন করে।’

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ওভারনাইট কলমানিতে যেখানে গড় সুদের হার ৫ দশমিক ৮০ শতাংশের আশপাশে। সেখানে তিন ও সাত দিনের শর্ট নোটিশে গড় সুদের হার সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ