ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কষ্টে আছে সবাই!

প্রকাশনার সময়: ১৪ অক্টোবর ২০২২, ০৮:২২

সিদ্দিক হোসেন। তিনিসহ ব্যাচেলর বেশ কয়েকজন রাজধানীতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন। এ বছরটা সবকিছুর দাম বৃদ্ধিতে তারা বেকায়দায় আছেন। গত বছর একই সময়ে যেখানে তাদের বাসা ভাড়া ও খাওয়া বাবদ খরচ হতো সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা। এ বছর সেখানে খাওয়ার মান কমিয়েও সাড়ে ৭ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। অর্থাৎ সব পণ্য বা সেবার দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। ফলে আগের থেকে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় জীবনযাত্রার মান কমেছে।

মূল্যস্ফীতির সরকারি হিসেবেও তার সত্যতা মিলছে। এ বছর সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধি ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই সংখ্যা দুই অঙ্কের ওপরে।

সিদ্দিক হোসেন নয়া শতাব্দীকে বলেন, যে পরিমাণে ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু আয় সেভাবে বাড়েনি। গত বছর এই সময়ে পণ্যের যে দাম ছিল—এ বছর তা থেকে অনেক বেশি। আয়-ব্যয় বৃদ্ধিতে যদি ভারসাম্য না থাকে তাহলে জীবনধারণ করতে সমস্যা। ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় আসলেই অনেক কষ্টে আছি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়ার আগেই বেড়ে যায়। অন্যদিকে দাম কমার ঘোষণা দেয়ার অনেক দিন হলেও কিন্তু তেলের দাম এখনও কমেনি। সরকার আর অসাধু ব্যবসায়ীরা এখানে একেবারে একাকার।

সরকারি হিসাব বলছে, দাম বেড়েছে সব পণ্যের। গত বছরের সেপ্টেম্বরে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত। সে পণ্য বা সেবা এখন ১০৯ টাকা ১০ পয়সা। অন্যদিকে, দিনমজুর-শ্রমিক বা অন্য পেশার মানুষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে তার শ্রমের বিনিময়ে ১০০ টাকা পেয়েছেন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে তারা পেয়েছেন ১০৬ টাকা ৮৬ পয়সা।

অর্থাৎ আয় থেকে ব্যয় দুটোই বাড়লেও ব্যয়ের পাল্লাই ভারী। কেননা আয় বাড়ার পরও ব্যয় বেড়েছে ২ টাকা ২৪ পয়সা। এর অর্থ হচ্ছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, সেই পণ্য বা সেবা পেতে এখন ১০৯ টাকা ১০ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে। আর যে দিনমজুর-শ্রমিক বা অন্য পেশার মানুষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে তার শ্রমের বিনিময়ে ১০০ টাকা পেয়েছেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে তারা পেয়েছেন ১০৬ টাকা ৮৬ পয়সা।

এই হিসাব বলছে, দেশের দিনমজুর-শ্রমিকসহ বেসরকারি পেশাজীবীরা যে বাড়তি আয় করছেন, তা দিয়ে সামাল দেয়া যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতির চাপ। উল্টো আরও বেশি খরচের বোঝা চাপছে তাদের মাথায়। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি আর মজুরি সূচকের মধ্যে ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২৪ শতাংশ পয়েন্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমনটি আর কখনোই দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে মানুষের সঞ্চয় বা জীবনযাত্রার বাড়তি চাহিদা মেটানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। সবাই কষ্টে আছেন।

গত ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা আট মাস ধরেই চলছে এ প্রবণতা। এই সময়ে দেশের মানুষের গড় মজুরি যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে জিনিসের দাম।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, গত জুনেও মূল্যস্ফীতির হার জাতীয় পর্যায়ে মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি ছিল। আগের চার মাসেও দেশে একই চিত্র ছিল। সাধারণ সময়ে মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির কিছুটা বেশি থাকে। তবে অর্থনীতির এই পরিচিত প্রবণতায় ছেদ ঘটেছে ফেব্রুয়ারি থেকে।

এর আগে করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের জুন মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম ছিল। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯০। গত এক দশকের মধ্যে সেটিই ছিল ব্যতিক্রম।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ, আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ, মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ১৫। পরের মাস এপ্রিলে মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছিল ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ।

মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, মজুরি বেড়েছিল ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। জুন মাসে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশে ওঠে, যা ছিল ৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বিপরীতে ওই মাসে মজুরি সূচক বেড়েছিল ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে আসে; ওই মাসে মজুরি সূচক ছিল ৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আগস্টে মজুরি সূচক বেড়ে ৬ দশমিক ৮০ শতাংশে ওঠে। মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ।

সবশেষ সেপ্টেম্বর মাসে মজুরি সূচক বেড়ে ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে অবস্থান করছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি এই তথ্যই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে দেশের মানুষ কষ্টে আছেন। দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন তারা। উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত ছাড়া সব মানুষই কষ্টে আছেন।

সাধারণত মূল্যস্ফীতি ও মজুরি হার বৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্য ১ শতাংশের মতো হয়। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি সূচক কমপক্ষে ১ শতাংশ বেশি হয়ে থাকে। যখন মূল্যস্ফীতি মজুরি বৃদ্ধিকে টপকে যায়, অর্থনীতির পরিভাষায় সেটিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলা হয়ে থাকে। আট মাস ধরে দেশে সেটিই হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরোর মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন আছে। বিবিএসের সঙ্গে সঙ্গে বাজারের পণ্যমূল্যের বাস্তব প্রতিফলন পাওয়া যায় না।’

আহসান মনসুর বলেন, ‘৫৫ টাকার কমে কোনো চাল পাওয়া যায় না বাজারে। ভোজ্যতেল, চিনি, ডালসহ সব জিনিসের দামই চড়া। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে পণ্যমূল্যে। বেড়েছে মানুষের পরিবহন খরচ।’

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে। এর জেরে বেড়ে চলা খাদ্যসংকট বিশ্বকে একটি মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে বলে বারবার সতর্ক করছে, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা। ছোট-বড় সব দেশেই এখন মূল্যস্ফীতি বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে।’

অর্থনীতির আরেক গবেষক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘গত মার্চ মাসে আমরা এক গবেষণা চালিয়ে দেখেছি, বিবিএসের তথ্যের চেয়ে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ। তারপরও বিবিএসের বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও মজুরি সূচকের তথ্য নিয়েই যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলেও কিন্তু আমরা উদ্বেগজনক একটি তথ্য দেখতে পাচ্ছি। আর সেটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ আয় বাড়লেও মানুষের তা দিয়ে চলছে না। হয় ধারদেনা করে চলছে; না হয় কম খাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি মানুষের বাড়তি আয় খেয়ে ফেলছে।’

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘বাজারের আগুনে মানুষের অবস্থা খারাপ, শুধু খারাপ বললে ভুল হবে; খুবই খারাপ। সব মানুষই কষ্টে আছেন। আর এই কষ্ট থেকে ক্ষোভ-হতাশা বাড়ছে। বিশেষ করে যারা নির্দিষ্ট আয়ের (ফিক্সড ইনকাম গ্রুপ) তারা খুব সংকটে রয়েছেন। সংসারের ব্যয় কাটছাঁট করতে করতে অবস্থা অনেকটা এমন যে, জামা কাটতে কাটতে দেখা যাবে আর কিছুই নেই।’

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ