ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ডলার সংকটে বিনিয়োগে শঙ্কা

প্রকাশনার সময়: ১১ অক্টোবর ২০২২, ০৮:২০

ব্যয় সংকোচনের অংশ হিসেবে আমদানি কমানো হয়েছে। বিলাসী ও কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানি কমায় কিছুটা সুফল মিলেছে বটে। কমেছে এলসি খোলার পরিমাণও। এতে সরকার কিছুটা হলেও খুশি। তবে এতে উল্টোপিঠও দেখতে পারে। দেশে নতুন বিনিয়োগের অন্যতম নির্দেশক মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি এক ধাক্কায় তলানিতে নেমে এসেছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে।

ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় মূলধনি যন্ত্রপাতির পাশাপাশি শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। এতে দেশে বিনিয়োগ কমার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংক পণ্য আমদানির সবশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য মাত্র ৩৯ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম।

২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ১১৫ কোটি ৩৩ লাখ (১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছিলেন শিল্পোদ্যোক্তারা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ের চেয়ে গত বছরের জুলাই-আগস্টে প্রায় তিন গুণ বেশি ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ২২ কোটি ১১ লাখ ডলারের এলসি খুলেছিলেন শিল্পোদ্যোক্তারা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে তা ১৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই মাসের চেয়ে আগস্টে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।

এর অর্থ হচ্ছে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা কলকারখানা স্থাপনে আগের চেয়ে যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। এতে দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে ‘ধস’ নামার একটা অশনি সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। কারখানা সম্প্রসারণ হোক অথবা নতুন কারখানা স্থাপন হোক মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমা-এটাই হলো তার পরিষ্কার ইঙ্গিত। টাকার বিপরীতে আমেরিকান মুদ্রা ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।

তারা বলেছেন, পণ্য আমদানির জন্য ব্যাংকগুলো এখনো ১০৫ টাকার বেশি নিচ্ছে। এতে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এত বেশি খরচ করে যন্ত্রপাতি আমদানি করে শিল্প স্থাপন করলে সেই শিল্প লাভজনক হবে কি না-তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। সে কারণেই সবাই মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছেন বলে মনে করছেন তারা।

মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। অর্থাৎ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, আগামী দিনগুলোতে দেশে শিল্প খাতে বিনিয়োগ কমবে। আর বিনিয়োগ কমা মানে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে না। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে না। সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেল এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির যে আবহ দেখা দিয়েছিল, তা কিছুটা হলেও হোঁচট খেয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতির গবেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে (১২ মাস, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৬৪৬ কোটি ৩৭ লাখ (৬.৪৬ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছিলেন উদ্যোক্তারা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি।

গত বছরের আগস্ট থেকে দেশে আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। টাকার বিপরীতে ডলারের দর অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে। এপ্রিল মাস থেকে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে একটার পর একটা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। যার সুফল জুন মাস থেকে পড়া শুরু করে। জুলাই-আগস্ট মাসে তা ভালোভাবে দৃশ্যমান হয়েছে।

এপ্রিল মাসের আগে গত অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ডলারের দাম বাড়ায় ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়।

ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে বেশ কয়েক মাস ধরে। বেড়েই চলেছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর এই মুদ্রার দর। কমছে টাকার মান। ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়াসহ নানা পদক্ষেপ নেয়ার পরও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে প্রায় ২২ শতাংশ।

গত বছরের ৪ অক্টোবর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলার-টাকার বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ ওই সময় ১ ডলার কিনতে ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা লাগত। গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার লেগেছে ১০৪ টাকা ১০ পয়সা।

কিছুদিন আগে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দর ১২০ টাকায় উঠেছিল। এখন অবশ্য তা ১১৫ টাকার নিচে নেমে এসেছে। ব্যাংকগুলো ১০৬ টাকা থেকে ১০৮ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক বৃহস্পতিবার ১০৭ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করেছে।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ লফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। যার চাপ পড়ে অর্থনীতিতে। আমদানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রফতানি ও রেমিট্যান্স না বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ গত ১২ জুলাই ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। গত তিন মাসে তা আরও কমে বৃহস্পতিবার ৩৬ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

গত ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য আমদানির জন্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা মোট ৯ হাজার ২২৩ কোটি ৪৯ লাখ (৯২.২৩ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৭০৩ কোটি ৭৪ লাখ (৬৭.০৩ বিলিয়ন) ডলার।

আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ১২ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। শুধু মূলধনি যন্ত্রপাতি নয়, এই দুই মাসে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। গত বছরের জুলাই-আগস্টে ৪৭৩ ৩২ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এই বছরের একই সময়ে খোলা হয়েছে ৪৩১ কোটি ২৩ লাখ ডলার। এ ছাড়া শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ। তবে জ্বালানি তেল আমদানিতে এলসি খোলার খরচ বেড়েছে ৭৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি কমা মানে, ভবিষ্যতে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, একটি কঠিন সময় পার করছে গোটা বিশ্ব। আমরাও তার বাইরে নই। এই অবস্থায় ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। স্বাভাবিক কারণে ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছেন। বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হবে, তখন আবার আমদানি করবেন। কিন্তু কবে স্বাভাবিক হবে, সেটাই এখন বড় বিষয়।

বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, অন্য সব পণ্যের সঙ্গে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমবে-এটাই স্বাভাবিক।

কেননা, ১০৫/১১০ টাকা দিয়ে ডলার কিনে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি করে শিল্প স্থাপন করলে, সেই কারখানা যখন উৎপাদনে যাবে-তা থেকে মুনাফা আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সে কারণেই উদ্যোক্তারা আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। এতে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ঠিক। কিন্তু লোকসান হতে পারে-এমন আশঙ্কা থেকে তো কোনো ব্যবসায়ী শিল্প স্থাপন করবে না।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ