ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সংকট কাটছে না কিছুতেই

প্রকাশনার সময়: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:২৯

ডলার নিয়ে অস্বস্তি অনেক দিন থেকে। ধীরে ধীরে এই সংকট আরও বড় হয়েছে। সংকট কাটাতে নানা পদক্ষেপ নিলেও কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। এবার অভিন্ন রেটের এক নীতি গ্রহণ করেছে সংশ্লিষ্টরা।

আন্তঃব্যাংক লেনদেন ও খোলা বাজারে অভিন্ন রেটে বিক্রি হবে ডলার। তবে বিষয়টির সমালোচনা করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্তের কোনো কিছুই বুঝতে পারছি না। ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া। কিন্তু ডলার বাজার স্থিতিশীল হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে।

গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের আলোকে ব্যাংকারদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ বা এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রার ডিলার ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন বা বাফেদা ঠিক করেছে, এখন থেকে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় হার হবে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা। তবে রফতানি আয় নগদায়ন হবে সর্বোচ্চ ৯৯ টাকায়। আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তির সময় ডলারের দাম হবে সর্বোচ্চ ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে পণ্য ও জ্বালানি মূল্যের উল্লম্ফনের কারণে দেশে দেশে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার যে অবমূল্যায়ন সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা থেকে বাদ নয় বাংলাদেশও। প্রায় দেড় বছর ডলারের দর ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল থাকলেও গত বছরের আগস্ট থেকে বাড়তে বাড়তে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে তা উঠে গেছে ৯৫ টাকায়, কিন্তু খোলাবাজারে একপর্যায়ে কেনাবেচা হতে থাকে ১২০ টাকায়। সেখান থেকে কিছুটা কমলেও ডলারের দর নিয়ে উদ্বেগ এখনো যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ৭.৬৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। তবে ডলারের মূল্যে অনেক পার্থক্য দেখে অবাক অর্থনীতিবিদরা।

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, এটা কোনো ভালো সিদ্ধান্ত হয়নি। এই সিদ্ধান্তে বাজার স্থিতিশীল না হয়ে উল্টো আরও অস্থির হয়ে উঠতে পারে। এই সিদ্ধান্তের কিছু বুঝতে পারছি না আমি।

তিনি বলেন, আমদানি কমাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। ডলার ছুটছে তো ছুটছেই। কার্ব মার্কেটে ডলারের দর ফের বাড়তে শুরু করেছে। গতকাল (রোববার) প্রতি ডলার ১১৪ টাকার বেশি দরে বিক্রি হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে নতুন যে সিদ্ধান্ত, তাতে জটিলতা আরও বাড়বে জানিয়ে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত না নিয়ে অদ্ভুত-উদ্ভট একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাফেদা-এবিবি। এই সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই ভালো ফল দেবে না। বাজারের চাহিদা-জোগান বিবেচনায় নিয়ে একটা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে না। তিনি বলেন, ‘টাকার বিপরীতে ডলারের অস্বাভাবিক উল্লম্ফন আমাদের অর্থনীতিকে প্রতি মুহূর্তে তছনছ করে দিচ্ছে। সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে আমাদের।

বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত কী হতে পারত—এ প্রশ্নের উত্তরে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর বলেন, ‘এ মুহূর্তে রেমিট্যান্স, রফতানি, আমদানির ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা দাম বেঁধে দেয়ার কোনো মানে হয় না। আমি মনে করি, এই তিন ক্ষেত্রে ডলারের একক দর নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। ব্যবধান খুব বেশি হলে ২ শতাংশ থাকতে পারে।’

তার মতে, ডলারের একক দর এখন ১০৫ টাকা বেঁধে (ফিক্সড) দেয়া উচিত। রেমিট্যান্স, রফতানি ও আমদানির ক্ষেত্রে দরের ব্যবধান বা পার্থক্য এক থেকে দেড় টাকা (খুব বেশি হলে ২ শতাংশ) হওয়া উচিত। তাহলেই বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

করোনার সময় ডলার কিনে দর ধরে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বেচে দর কমাতে চাইছে। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে ওই অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু আগস্ট মাসেই চিত্র উল্টে যায়।

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রফতানি বাড়লেও কমতে থাকে প্রবাসী আয়। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চলে পুরো অর্থবছর।

সেই ধারাবাহিকতায় চাহিদা মেটাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে আমেরিকান মুদ্রা ডলারের দৌড় থামাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (২ মাস ১১ দিন) ২৭০ কোটি (২.৭০ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর পরও বাজারে ডলারের সংকট কাটছে না।

তবে চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ফের বাড়তে শুরু করেছে। একই সঙ্গে আমদানি ব্যয়ও কমা শুরু করেছে। তবে এর মধ্যেও গত ২৬ মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়নের ঘরে নেমে গেছে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ