ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

চিড়েচ্যাপ্টা মধ্যবিত্ত!    

প্রকাশনার সময়: ১৭ জুন ২০২২, ১২:১৯ | আপডেট: ১৭ জুন ২০২২, ১২:২৪

করোনার অভিঘাত থেকে মুক্তি মেলার আগেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে বেসামাল বিশ্ব। হু-হু করে বাড়ছে সব পণ্যের মূল্য। পণ্যের দাম বাড়লেও বাড়েনি মধ্যবিত্তের আয়। করোনায় আয় হারানোরা এখনো পূর্বের অবস্থায় ফিরতে পারেননি। বর্তমানে নিত্যপণ্যের বাজারে চলছে দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা। কোন পক্ষ কত বাড়াতে পারে— চলছে যেন সেই লড়াই। আজ তেলের দাম বাড়ছে তো- কাল গ্যাস-পানির। পরের দিন বিদ্যুৎ আর চালের। এভাবেই দাম বৃদ্ধির অসম লড়াইয়ে এক পণ্যের দাম একাধিকবার বাড়ানো হচ্ছে। নিত্যপণ্যের সঙ্গে ঘোড়দৌড়ের মতো বাড়ছে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও বাড়ি ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক সব খরচ। একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে ওটার দাম কমার কোনো কথা তো নেই— উল্টো বাড়ছে। শুধু নিত্যপণ্যই নয়, জীবনঘনিষ্ঠ সব উপকরণেরই দাম বেড়েছে। ব্যয় অনুপাতে বাড়েনি আয়। মাসের আয়ের সিংহভাগই চলে যায় বাজারে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে মধ্যবিত্তের রীতিমতো ‘চিড়েচ্যাপটা’ অবস্থা। বিষয়টি নিয়ে সরকারের মাথা ব্যথা নেই বলে অভিযোগ জনসাধারণের। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির ফলে মধ্যবিত্তদের জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন আরো যেভাবে দাম বাড়ছে তাতে মানুষের জীবন ধারণ করা অনেক কঠিন। দাম যদি এখনই নিয়ন্ত্রণে না আনা যায় তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।

সাধারণ মানুষ বলছেন, দ্রব্যমূল্য যে হারে বাড়ছে তাতে আমাদের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই দায়। এখনই নিয়ন্ত্রণে না এলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে।

বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপে উঠে আসা তথ্যমতে, করোনাকালে আয় কমেছে দেশের ৬০ শতাংশেরও বেশি কর্মজীবীর। অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছেন দেশের চাকরি, ব্যবসাসহ নানা পেশায় জীবিকা নির্বাহ করা মধ্যবিত্তরা। এই শ্রেণির অনেকেই করোনাকালে চাকরি হারিয়েছেন, আবার কারো বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি অন্য কাজের উৎসগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ সংসার চালানোর নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। সামাজিক অবস্থান ধরে রাখতে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। কারো সংসারের খরচ কমাতে কমাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে কিন্তু বলতে পারছেন না। রাজধানীসহ সারাদেশের মধ্যবিত্তের চেহারায় এখন বিষণ্নতার ছাপ স্পষ্ট।

তারা বলছেন, করোনাকালে চাকরি হারানোরা এখনো চাকরি ফিরে পায়নি। এছাড়া যারা নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছে তারাও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে।

করোনায় বিনিয়োগ ও আমদানি-রফতানিতে মন্দার কারণে দেশের গত কয়েক বছরের গতিশীল অর্থনীতি যেমন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি কর্মসংস্থান হারিয়ে আয়শূন্য হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। অন্যদিকে করোনায় সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী মন্দার ঢেউও এই সময়ে আছড়ে পড়ে বাংলাদেশের ওপর। কারণ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে গুটিকয়েক পণ্য ছাড়া বেশিরভাগই বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর। করোনার শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে অব্যাহতভাবে জ্বালানি তেলসহ জীবন ধারণে ব্যবহূত সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ চেইন ব্যাহত হয়। একইসঙ্গে দামও বাড়তে থাকে। এসবের উত্তাপ এসে লাগে দেশের সার্বিক দ্রব্যমূল্যেও। যাতে পিষ্ট হচ্ছে মধ্যবিত্তরা।

সমস্যা পড়া জাহিদ হাসানের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, করোনা শুরু হলে বেতন অর্ধেক করা হয়েছিল। পরে অবশ্য করোনার মাঝখানে চাকরি চলে যায়। বড় সমস্যায় পড়েছিলাম। কাউকে কিছু বলতে পারিনি। অনেক চেষ্টার পরে একটা চাকরি পেয়েছি, তবে আগের মতো বেতন পাচ্ছি না। অল্প বেতনে বাধ্য হয়ে চাকরিতে জয়েন করেছি।

বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্য বলছে, গত সোয়া এক বছরে নতুন করে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছে দেশের আড়াই থেকে ৩ কোটি মানুষ। অর্থাৎ সবারই সংকট আয়ের ধারাবাহিকতা। নগদ অর্থে বড় রকমের টান পড়ায় বদলে গেছে আগের জীবন ব্যবস্থাও। জীবন-জীবিকার তাল মেলাতে হিমশিম খাওয়া মানুষের চাহিদায় ব্যাপক পতন ঘটেছে। তারা উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন ব্যয় সংকচোনের পথ।

নিজেদের উপযোগ কমিয়ে দিয়েছে মধ্যবিত্তরা। তারা প্রয়োজন বিবেচনায় গুরুত্ব দিচ্ছে অগ্রাধিকার খাতকে। প্রয়োজনের সঙ্গে আপস করে অল্প খেয়ে পরে কোনোমতে বেঁচে থাকার চেষ্টায় লিপ্ত। এসবের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যক্তি খাতের চাহিদা ও ভোগব্যয়ের ওপর। দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত মধ্যবিত্তরা।

২০০০ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০০৫ সালে তা নেমে এসেছিল ৪০ শতাংশে। এরপর ক্রমে দারিদ্র্যের হার কমেছে। যেমন, কোভিডের আগে সরকারি হিসাবে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। মহামারিতে কত মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, এর কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। তবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম জরিপ করে বলছে, ৪২ শতাংশ মানুষ এখন দরিদ্র। অর্থাৎ, এক কোভিডেই বাংলাদেশ প্রায় ২০ বছর আগের অবস্থানে ফিরে গেছে।

মূলত মধ্যবিত্ত যারা, তারাই আয় হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। সুতরাং, মধ্যবিত্ত বিকাশের ওপর নির্ভর করে অর্থনীতি আরো এগিয়ে যাবে বলে যে প্রত্যাশা ছিল, তা অনেকটাই হোঁচট খেয়েছে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে গতানুগতিক নীতি বদলে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের যে চ্যালেঞ্জ, সরকার তা কতটুকু নিতে পারবে, সেটাই বড় প্রশ্ন।

বেসরকারি খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর নয়া শতাব্দীকে বলেন, সবার আগে আমাদের চাহিদাযোগ্য পণ্য ও সেবার জোগান বাড়াতে হবে। জোগান বাড়াতে হলে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতগুলোকে সচল করে তুলতে হবে। আমদানির উৎস্য দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। এসবের জন্য বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও পুনঃবিনিয়োগ দরকার। একই সঙ্গে সরকারি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। এই বিনিয়োগ বাড়লে বেসরকারি খাত চাঙা হবে। এতে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কর্মসংস্থান বাড়লে আয়ও বাড়বে। আর আয় বাড়লে মানুষের চাহিদা, ভোগ ও বিলাসিতা সবটাই বাড়বে। আর তাতেই ভালো থাকবে মধ্যবিত্তরা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, মধ্যবিত্তরাই হলো মূল সোপান। তারা ভালো থাকলে দেশের অধিকাংশ মানুষই ভালো থাকবে। তাই সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ২৩টি খাতে ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার যে প্রণোদনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে, তার সফল বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে। তখন মানুষের ভোগ সক্ষমতাও বাড়বে। এর জন্য আগামী দুই-এক বছর অপেক্ষা করতেই হবে।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, মধ্যবিত্তরা এখন বড় সমস্যায় রয়েছে। সব দ্রব্যের দাম বেশি, তবে করোনার কারণে কমেছে আয়। তাছাড়া তারা কখনোই সরকার বা কারো কাছে কিছু চায় না। তারা যে সমস্যায় আছে তা তারা কারো কাছে বলতেও পারছে না। ফলে করোনায় তারা এখন সবচেয়ে বেশি সমস্যায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের নিয়ে সরকারের কোনো ম্যাকানিজমও নেই। সরকার জানেও না এই সমস্যায় পড়া মধ্যবিত্তের সংখ্যা কত? অবশ্যই সরকারের নীতিনির্ধারক যারা আছেন তাদের যা করতে হবে তা হলো, পরিস্থিতি বুঝতে হবে। তারা যদি এই পরিস্থিতি বুঝতে না পারেন তাহলে সংকটে যারা আছে তাদের সহায়তা করতে পারবেন না। সরকারকে এই মানুষদের কাছে সহায়তা পৌঁছে দিতে হবে। তবে সরকার ফোন নম্বরের মাধ্যমে যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। সেটা করতে পারলে মধ্যবিত্তের কিছু সমস্যা সমাধান হবে।

নয়া শতাব্দী/এমএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ