দেশে বর্তমানে কালো টাকা ৮৮ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। গত ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০১৮-২০১৯ বছর পর্যন্ত এই টাকা রয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। তারা বলছে, এ সময় বিদেশে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৮ লাখ কোটি টাকা। এছাড়া আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য বিকল্প বাজেট পেশ করেছে তারা। বাজেটে মোট ৩৩৮টি সুপারিশ করা হয়েছে।
গতকাল রোববার অর্থনীতি সমিতির অডিটোরিয়ামে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২২-২৩: একটি জনগণতান্ত্রিক বাজেট প্রস্তাব’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত এসব তথ্য জানান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম।
সংবাদ সম্মেলনে তারা ২০ লাখ ৫০ হাজার ৩৬ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট পেশ করেন। এতে অভ্যন্তরীণ উৎস রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। বিকল্প বাজেটে মোট ৩৩৮টি সুপারিশ দেয়া হয়েছে। যেখানে প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দেয়ার পাশাপাশি কালো টাকা উদ্ধার ও পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে বাজেট ঘাটতি পূরণের কথা বলা হয়েছে। বিকল্প বাজেটে বৈদেশিক ঋণ ও ব্যাংক ঋণকে নিরুৎসাহ করা হয়েছে।
দেশের আয় বৃদ্ধি ও বাজেট ঘাটতি পূরণের বিষয়ে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে অন্যতম উৎস হলো সম্পদ কর ও অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর। এছাড়া কালো টাকা উদ্ধার থেকে প্রাপ্ত অর্থ এবং পাচার ও বিদেশি নাগরিক থেকে প্রাপ্ত কর। তাই আমরা ওই টাকা সংগ্রহের কথা বলছি। কালো টাকা ও অর্থ পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০১৮-২০১৯ বছর পর্যন্ত আমাদের হিসাবে বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ ৮৮ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। আমরা গত ৪৬ বছরে পুঞ্জীভূত কালো টাকার মাত্র দুই শতাংশ উদ্ধারের প্রস্তাব করছি। যেখান থেকে এক লাখ ৭৭ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা আসবে। ওই ৪৬ বছরে বিদেশে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৮ লাখ কোটি টাকা। আমরা তার ১০ শতাংশ উদ্ধার করে বাজেটে আয় খাতে ব্যবহার করার জন্য প্রস্তাব করেছি। যার পরিমাণ ৭৯ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও কালো টাকা উদ্ধারে আমরা একটি স্বাধীন কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব করছি।
আবুল বারকাত বলেন, প্রস্তাবিত জনগণতান্ত্রিক ২০ লাখ ৫০ হাজার ২৬ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করছি। যা বর্তমান বাজেটের তুলনায় ৩.৪ গুণ বেশি। যেখানে ৩৩৮টি সুপারিশ রয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে— সমাজ থেকে চার ধরনের বৈষম্য যথা— আয়বৈষম্য, সম্পদবৈষম্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাবৈষম্য ক্রমাগত হ্রাস করে নির্মূলের দিকে যাওয়া। এ লক্ষ্যে আয় ও ব্যয় খাতে মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। দ্বিতীয়ত বাজেটে অর্থায়নের প্রান্তিক, দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্য মধ্যবিত্তের ওপর কর দাসত্ব আরোপ করা যাবে না। এরপর রয়েছে সামাজিক সুরক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের সুপারিশ।
মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে। শর্ত হলো কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। সরকার মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দিচ্ছে তা বাস্তবসম্মত নয়। দ্বিতীয়ত খাদ্য মূল্যস্ফীতি কোনো অবস্থাতে বাড়ানো যাবে না।
সরকারের চলমান মেগাপ্রকল্প প্রসঙ্গে বারকাত বলেন, মেগাপ্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ নিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, যখন থেকে আমরা অন্তত ৪-৫টি মেগাপ্রকল্পের সুদ পরিশোধ শুরু করব, তখন থেকেই ঋণের ক্ষেত্রে সরাসরি রেড জোনে চলে যাব। যা আনুমানিক হিসাবে ২০২৭-২০২৮ সালে শুরু হওয়ার কথা। আর ২০৩২ সালে যখন ১২টি মেগাপ্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে যাব, তখন বিপদ আরো প্রকট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বৈশ্বিক মহামন্দা, বৈশ্বিক মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব ভবিষ্যতে আমাদের বৈদেশিক ঋণের রেড ঝুঁকিতে ফেলবে কিনা তা নিয়ে কঠিন চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের মেগাপ্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ যখন শোধ করা শুরু হবে তখন আমরা সরাসরি রেড ঝুঁকিতে চলে যাবে। সংকট সমাধানে আর কোনো মেগা প্রজেক্ট নেয়া যাবে না, কোনো প্রজেক্টের মেয়াদ বাড়ানো যাবে না। আবুল বারকাত বলেন, আমরা প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দিতে বলেছি। কারণ পরোক্ষ করের কারণে মানুষে মানুষে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। আমরা প্রস্তাব করছি দরিদ্র অতি দরিদ্রদের আগামী কয়েক বছরে নেটের বাইরে রাখার।
রাজস্ব আয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের বাজেটের আকার, যা বর্তমান বাজারের ৩.৪ গুণ বেশি। বিকল্প বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। যা প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটের ৯২ শতাংশের বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয়ের ৭৭ শতাংশ আসবে প্রত্যক্ষ কর থেকে, বাকিটা পরোক্ষ কর। যেখানে প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে মাত্র ৪৬ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি ৭ শতাংশ, যা সরকারের চলতি বাজেটে ঘাটতি তুলনায় অনেক কম। বাজেট ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক ঋণ কিংবা দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণের প্রয়োজন নেই। সমস্যাটা অর্থনৈতিক হলেও সমাধান তার রাজনৈতিক। বাজেট ঘাটতি পূরণে তিনি কালো টাকা ও বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরতের প্রতি জোর দেন।
সমিতির সভাপতি বলেন, আমাদের আরেকটি বড় কষ্ট হলো সবকিছু এককেন্দ্রিক ও ঢাকামুখী, যা উন্নয়ন সহায়ক নয়। তাই আমাদের প্রস্তাবে কোন মন্ত্রণালয়, কোন বিভাগে যাবে এটি রয়েছে।
বারকাত বলেন, আমাদের বাজেটে মোট বরাদ্দে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। এখানে মোট বরাদ্দ বাজেটের ২১ শতাংশ। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার খাত হচ্ছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত, তৃতীয় হচ্ছে কৃষি। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ সব ধরনের বৈষম্য বেড়েছে। এসব পাল্টাতে হবে, ঝুঁকি হ্রাস করতে হবে। সেজন্য আমরা গবেষণা ও বিজ্ঞান চর্চা অধিক গুরুত্ব দিয়েছি। গবেষণা উন্নয়নের গুরুত্ব বিবেচনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমরা নতুন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব করছি। যার নাম গবেষণা উদ্ভাবন বিচ্ছুরণ ও উন্নয়ন। এই মন্ত্রণালয়ের জন্য আগামী পাঁচ বছরে ৫ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলছি। আরেকটি মন্ত্রণালয়ের কথা আমরা বলেছি সেটা হলো গণপরিবহন মন্ত্রণালয়।
বিকল্প বাজেট সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও কনফারেন্সে দেশের ৬৪টি জেলা, ১০৭টি উপজেলা এবং ২১টি ইউনিয়ন থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধি ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। চলতি অর্থবছরে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাজেটের আকার বা মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৭.৫ শতাংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয় ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ