ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদেশি ঋণধারীদের সর্বনাশ

প্রকাশনার সময়: ২৮ এপ্রিল ২০২২, ১০:১৩

ডলারের দাম এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আগের যে কোনো সময় থেকে টাকার বিপরীতে দামও গিয়ে সর্বোচ্চ ঠেকেছে। গতকালও বেড়েছে ডলারের দাম। আন্তঃব্যাংক লেনদেনেও ডলারের দাম বাড়ছেই। খোলাবাজারেও তা থেমে নেই। নগদ ডলার কিনতে এখন গুনতে হচ্ছে ৯২ টাকার মতো। এভাবে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ঋণধারীদের হাঁসফাঁস অবস্থা ।

করোনায় অচলাবস্থা সৃষ্টির পর অর্থনীতি আগের অবস্থানে ফেরার চেষ্টা করছে। ফলে শিল্পে উৎপাদন বেড়েছে। আর এই খাতে অর্থায়নের জন্য দেশি উৎসের পাশাপাশি এখন বেশিসংখ্যক উদ্যোক্তা বিদেশি ঋণে ঝুঁকছেন। কম সুদের বলে বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা ব্যবসায়ীরা ডলারের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন। ফলে দেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সুদ-আসলে যে টাকা পরিশোধ করতে হতো, এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হবে।

বলা হচ্ছে দেশের তুলনায় বিদেশি ঋণে সুদহার কম। তবে ঋণের অর্থ ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রায় দেশে আসে আর তা পরিশোধও করতে হয় বিদেশি সেই মুদ্রায়। এ কারণে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার যদি বেড়ে যায়, তাহলে ঋণগ্রহীতাদের বেশি দামে তা কিনতে হবে। ফলে তাদের প্রত্যাশিত অর্থের চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হতে পারে।

টানা কয়েক বছর টাকার সঙ্গে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকলেও এখন পরিস্থিতি অন্য রকম। ডলারের দর হঠাৎ করেই এখন চড়া। আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলার বিনিময় হার এখন ৮৬.২০ টাকা। তবে বছর কয়েক আগেও ছিল ৭৬ থেকে ৭৭ টাকা। ফলে সে সময় যারা ঋণ নিয়েছেন ঋণগ্রহীতাদের প্রত্যাশিত অর্থের চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে ৫ বছর আগে যারা বিদেশ থেকে ঋণ এনেছেন, তাদের বিনিময় হারের কারণে ১০ শতাংশ বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। বছর পাঁচেক আগেও বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার ১২ শতাংশের বেশি থাকায় বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও বিদেশি ঋণে ঝুঁকতে শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। তবে এখন দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ভালো ঋণদাতা ও বড় অঙ্ক হলে এর চেয়ে কম সুদেও ঋণ দেয়া হচ্ছে।

ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরফান আলী বলেন, ঋণ ডলারে পরিশোধ করলে ব্যবসায়ীদের কিছুটা লস হবে। কারণ ডলারের দর বেশ ঊর্ধ্বমুখী। ফলে ৫ বছর আগে নেয়া ঋণে বাড়তি পেমেন্ট করতে হবে। সব মিলিয়ে ঋণের বিপরীতে সুদ ৭ থেকে ৮ শতাংশ হয়ে যায়। তিনি বলেন, আমরা যেভাবে বাইরের ঋণ লাভজনক মনে করি তেমন নয়। গত পাঁচ বছর ডলারের দর স্থিতিশীল ছিল। এজন্য অনেকে বিদেশি ঋণে বেশি উৎসাহী হয়েছে। এখন আবার বিদেশি ঋণের আগ্রহ কমে যাবে।

বিদেশ থেকে দেশি উদ্যোক্তাদের ঋণ সংগ্রহের সুযোগ প্রায় চার দশক আগেই করে দেয়া হয়েছে। ১৯৮৫ সালে ‘অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট’ নামে ব্যাংকের আলাদা বিভাগ গঠন করা হয়। বর্তমানে ৩৬টি ব্যাংক এই বিভাগ গঠন করে ঋণ বিতরণ করছে। প্রথম দিকে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা এ সুবিধা নিলেও পরে অন্য খাতের উদ্যোক্তারাও এই সুবিধা নিতে শুরু করেন।

২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি বিদেশি ঋণ নেয়ার পথ আরো প্রশস্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে বিদেশি মালিকানাধীন সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানও মূল কোম্পানি (প্যারেন্ট) থেকে ঋণ নিতে পারবে। তবে এ সুবিধা ট্রেডিং ব্যবসার জন্য প্রযোজ্য হবে না। উৎপাদন ও সেবা কার্যক্রম শুরু থেকে ছয় বছর পর্যন্ত এই সুবিধা নেয়া যাবে। আগে এই সুবিধা তিন বছর পর্যন্ত নেয়া যেত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৫৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৩০৮ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় এক লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা।

২০২০ সাল শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ ছিল এক হাজার ৪৭৬ কোটি ডলার বা এক লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। এক বছরে বেড়েছে ৮৩২ কোটি ডলার। টাকার হিসাবে গত এক বছরে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৭২ হাজার কোটি টাকা। এর আগে এক বছরে এত বেশি হারে বাড়েনি।

বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিতে বড় জোগানদাতা বা মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে দেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকের শাখাগুলো। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে এইচএসবিসি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড। অন্যদিকে, দেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে শীর্ষপর্যায়ে রয়েছে ইস্টার্ন, সিটি, ব্র্যাক, এবি ও ইসলামী ব্যাংক।

অগ্রণী, আল-আরাফাহ, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা, ডাচ্-বাংলা, এক্সিম, আইএফআইসি, যমুনা, মার্কেন্টাইল, মিডল্যান্ড, মধুমতি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল, এনসিসি, ওয়ান, প্রিমিয়ার, প্রাইম, পূবালী, শাহজালাল, সোস্যাল ইসলামী, সাউথইস্ট, স্ট্যান্ডার্ড, ট্রাস্ট, ইউসিবি, উত্তরা, সিটি এনএ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অফ সিলন, স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া ও উরি ব্যাংকের মাধ্যমেও এ ঋণ দেয়া হয়।

উল্লেখ্য, বেশ কিছুদিন ধরে অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার বাজার। বিশেষ করে ডলারের দরে হঠাৎ তেজিভাব। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকা ২০ পয়সা। এক বছর আগে এ দর ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ দাম বেড়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকে এক ডলার ৯২ টাকা গুনতে হচ্ছে।

এমন অবস্থায় সরবরাহ বাড়াতে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ৯৬ কোটি ৭ লাখ ডলার খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। একই সঙ্গে বিলাসবহুল পণ্য আমদানিকে কিছুটা নিরুৎসাহিত করতে এক সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক জরুরি ছাড়া অন্য পণ্য আমদানিতে এলসি খোলার ক্ষেত্রে নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছে। আগে এ হার ব্যাংক গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে ঠিক করত।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ