ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়ার পর ফের অস্থির ভোজ্যতেলের বাজার। পাম তেলের সঙ্গে সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে সয়াবিন তেলের বাজারেও। এতে সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম কেজিতে বেড়েছে আরো ১০-১৫ টাকা। যদিও দাম বাড়ার বিষয়ে সরকারিভাবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এছাড়া ঈদের আগে হঠাৎ বাড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা। গত সপ্তাহে যে পেঁয়াজ ২৫ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে, এখন খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট দেশের বাজারেও প্রভাব ফেলতে পারে এমন আশঙ্কায় তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। ফলে চাহিদা মতো তেল মিলছে না। বিশেষ করে খোলা তেলের ঘাটতি বাড়ছে দ্রুত। এ অবস্থায় সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাইছেন মালিকরা।
দেশে ভোজ্যতেল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় পাম তেল। পণ্যটির চাহিদা পূরণ হয় মূলত ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানির ভিত্তিতে। গত শুক্রবার এক বিবৃতির মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া থেকে পাম অয়েল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো। চলতি সপ্তাহেই তার এ ঘোষণা কার্যকর হচ্ছে। ইতোমধ্যেই এই ঘোষণার প্রভাব শুরু হয়েছে দেশের বাজারে।
এর আগে রমজানের শুরুতে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর দাবি করেছিলেন মিল মালিকরা। কিন্তু তাতে সরকার সায় না দেয়ায় বাজারে তেলের সরবরাহ সংকট দেখা দেয়। সেই সঙ্গে কেজিপ্রতি ১০ টাকা বাড়ে সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম।
গতকাল রাজধানীর বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, আগের বাড়তি দামের তুলনায় আরেক দফা বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত তিন আগের তুলনায় ১৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে তেলের দাম। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১৮২-১৮৫ টাকা কেজি। যা আগে ছিল ১৬৮-১৭০ টাকা কেজি। তবে বোতলজাত তেল দাম আগের দামই রয়েছে। কোথাও ১৬৮ টাকা লিটার। আবার কোথাও ১৬০ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে। পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৭২ টাকা কেজি। তিন দিন আগে পাম তেল বিক্রি হয়েছে ১৬০-১৬২ টাকা কেজি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকার মেসার্স ভুইয়া এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. শিবলী সাইদি বলেন, শুনেছি ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। এই খবর শুনেই তেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে বড় ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা। আমরা চাহিদা মতো তেল পাচ্ছি না। দেশে মোট ব্যবহূত ভোজ্যতেলের প্রায় ৬৫ শতাংশই পাম অয়েল। পণ্যটির চাহিদার পুরোটাই পূরণ হয় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে আমদানির মাধ্যমে। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশ আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা হয় বাকি ১৩ শতাংশ। বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, তেল নিয়ে যাতে ঈদের আগে নতুন করে নৈরাজ্য না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দাম বেড়ে যাওয়ার তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। আমরা ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করব। কোনো দেশ এখন যদি রফতানি বন্ধ করে, এতে দেশের বাজারে এখনই দাম বেড়ে যাওয়ার কথা নয়। কারণ এই প্রভাব বাজারে পড়তে সময় লাগবে। আমরা তা খতিয়ে দেখছি। পাশাপাশি ভোজ্যতেল নিয়ে যাতে কোনো ধরনের কারসাজি বা কৃত্রিম সংকট না করতে পারে, সেজন্য পর্যাপ্ত নজরদারি করা হচ্ছে। মিল থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মিলে কী পরিমাণে মজুদ আছে, সে হিসাব নেয়া হচ্ছে। কী দরে আমদানি করা হয়েছে, সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। এছাড়া ব্যবসায়ীরা তেলের দাম বাড়াতে প্রস্তাব দিয়েছে। ঈদের পর সভা করে দাম বাড়ানো হবে কি না, এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দেবে। পরিস্থিতি যা হোক, তেল নিয়ে আর নৈরাজ্য হতে দেয়া হবে না।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ গোলাম মাওলা বলেন, ইন্দোনেশিয়ার এ নিষেজ্ঞার কারণে সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম বাড়বে। এরই মধ্যে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে, সামনে আরো বাড়বে। ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে গত মাসে এ জাতীয় আমদানি ও বিপণনে মোট ২০ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছিল সরকার। ওই সময় সরকারিভাবে খোলা সয়াবিনের দাম পাইকারিতে লিটার প্রতি ১৪০ ও পাম অয়েলের দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বোতলজাত সয়াবিনের দাম ধরা হয় ১৬৮ টাকা। পরে রোজা শুরুর আগে বোতলজাত তেলে ৮ টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকা করা হয়। ওই সময়ে পাইকারি পর্যায়ে পাম অয়েলের দাম মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ৫০৫০ ও সয়াবিনের পাইকারি দাম ৫৬০০ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু সরবরাহ সংকটসহ নানা কারণে ভোজ্যতেলের দাম আবারো বাড়তে থাকে। বর্তমানে পাইকারিতে খোলা পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৬ হাজার ২০০ থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকায় (মিলগেট থেকে পাইকারি পর্যায়ের বিভিন্ন ধাপে)। এছাড়া সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৭০০০-৭৫০০ টাকা। এনবিআরের তথ্য বলছে, দেশে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১০ লাখ ২২ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে। এর মধ্যে ৬ লাখ ৬১ হাজার টন পাম অয়েল ও ৩ লাখ ৬১ হাজার টন সয়াবিন।
এদিকে, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কোনো কারণ দেখাতে পারেনি খুচরা ব্যবসায়ীরা। তবে পাইকাররা বলছেন সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে। পেঁয়াজের বাজার একটু চড়া বলছেন কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা জাহিদ হাসান। তিনি জানান, গত তিন-চার দিন ধরে পেঁয়াজের দাম একটু বেশি। আজকে পেঁয়াজ খুচরা দেশি ৩২ টাকা আর হাইব্রিড ৩০ টাকায় বিক্রি করছি। দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা পাইকারদের কাছ থেকে কিনে বিক্রি করি। তারা দাম বাড়িয়েছে। তবে তারা বলছে সরবরাহ কম, তাই দাম বেশি। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, আমরা যতটুকু জেনেছি এবার পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়েছে। তারপরও হঠাৎ দাম কেন বাড়ছে বিষয়টি দেখতে আমাদের তদারকি টিম মাঠে যাবে। কৃষি বিপণন অধিদফতরের এসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়। যদি কেউ সরবরাহর কথা বলে নিয়মবহির্ভূতভাবে দাম বাড়িয়ে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী, ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ