ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি

প্রকাশনার সময়: ২৩ এপ্রিল ২০২২, ১০:২৪

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু সেই লক্ষ্য ছাড়িয়ে বেড়েই চলেছে মূল্যস্ফীতি। গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৬ শতাংশ অতিক্রম করে। নানাভাবে চেষ্টা করেও বাজেটে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখতে পারছে না সরকার। চলতি অর্থবছরে পর পর তিন মাস গ্রামে ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি। এতে গত তিন মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গ্রামে সর্বোচ্চ দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। যেখানে শহরে ৬ শতাংশের কম ছিল, শহরে সর্বোচ্চ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ সময় সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২২ শতাংশে এবং খাদ্যখাতে এসময় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। মার্চ মাসেও শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি। এ সময়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ ও শহরে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টার কমতি নেই অর্থ বিভাগের। সরকার যে কোনো মূল্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় বলে জানিয়েছেন তারা। তাই মূল্যস্ফীতির হার যেন কোনোভাবেই ৬ দশমিক ৫ শতাংশের উপরে না ওঠে তা নিয়ন্ত্রণে কিছু কৌশলের কথা ভাবছে সরকার। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কর্মসৃজন, প্রণোদনা প্যাকেজ ও খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রম গ্রহণ। যদিও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ জটিল করে তুলেছে। তারপরও অর্থ বিভাগের চেষ্টার কমতি নেই বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

অপরদিকে, সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা ভেবে বিভিন্ন নিত্যপণ্যে ভর্তুকি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে সরকার মনে করে ভর্তুকির চাপ কমাতে হলে অবশ্যই গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো উচিত। কিন্তু তা করা হলে অর্থনীতিতে এর প্রভাব কেমন পড়বে এবং সেটা কীভাবে পূরণ করা সম্ভব হবে সেগুলো নিয়েও পর্যালোচনা হচ্ছে।

সূত্র মতে, রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এতে সারা বিশ্বেই নিত্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। সব জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা ভেবে বিভিন্ন নিত্যপণ্যে ভর্তুকি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে ভর্তুকির লাগাম টানতে মূল্য সমন্বয় করার কথাও ভাবা হচ্ছে। তবে এ ভর্তুকির লাগাম টানতে মূল্য সমন্বয় করা হলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ার আশঙ্কাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরকার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশের দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় যদি কর্মসৃজন করা যায়, তাহলে মানুষের আয় বাড়বে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়বে। ভর্তুকির বিপরীতে মূল্য সমন্বয় করলেও চাপ পড়বে না। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমবে। এছাড়া সাধারণ মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে নিত্যপণ্য সরবরাহ করা হলে সেক্ষেত্রেও মূল্যস্ফীতির চাপ কম থাকবে। একই কারণে এসব এলাকায় সরকারের ওএমএস কার্যক্রম পরিচালনার কথাও ভাবা হচ্ছে। এতে একদিকে ভর্তুকির পরিমাণ কমবে, ফলে মূল্য সমন্বয় না করলেও চাপ কম থাকবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশের যে ৬০টি উপজেলায় দারিদ্র্যের হার ৩০ শতাংশের ওপরে, সেসব অঞ্চলে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণের কথা ভাবছে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা। অতিদারিদ্র্যপ্রবণ এসব অঞ্চলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসৃজন করবে এমন একটি লক্ষ্যভিত্তিক প্রণোদনা প্যাকেজ গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বা তার বেশি হলে সারা দেশে সীমিত সময়ের জন্য ওএমএস কর্মসূচি চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের।

জানা গেছে, চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে বেড়ে যাওয়া জ্বালানি তেল, সার, গ্যাসের বর্ধিত মূল্য সমন্বয় করতে হচ্ছে সরকারকে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগামী বছরের জন্য ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে বড় ধরনের বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে। ফলে উল্লেখিত তিনটি খাতে নতুন বাজেটের ৪৯ শতাংশই ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। টাকার অঙ্কে এটি ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। আগামী ৯ জুন জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থ বিভাগ এরই মধ্যে বাজেটে রূপরেখা প্রণয়ন করেছে। যা সম্প্রতি বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির সভায় চূড়ান্ত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বর্তমানে ৫৩ শতাংশ সেচ কাজে ডিজেল ব্যবহার করা হয়। যার দাম এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া ৪৭ শতাংশ সেচ কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। যার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে কৃষকরা ব্যাপক চাপে পড়বেন। যা জনজীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। তাই শুধু কৃষকদের জন্য একটি পৃথক লক্ষ্যভিত্তিক প্রণোদনা প্যাকেজ গ্রহণ করার কথা ভাবছে সরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দিলেও এর মূল্য সমন্বয় না করায় সরকারের ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে ব্যয় বেড়েছে। নতুন বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণে বরাদ্দ থাকছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৪ শতাংশের সমান। চলতি বছরের তুলনায় এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে ২৭ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছর ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ বাবদ বরাদ্দ দয়া আছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। জানা গেছে, অর্থনীতির নানা দিক থেকে চাপের মধ্যে আছে সরকার। ফলে ব্যয় সংকোচন নীতি কৌশল নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছু বরাদ্দ খাত আছে যেখানে ব্যয় কাটছাঁট করা সম্ভব নয়। এর একটি হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। আগামী বছরে এখাতে বরাদ্দ দয়া হচ্ছে ৭৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৬ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা বেশি। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ আছে ৬৯ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার জনবান্ধব সরকার। সাধারণ মানুষের সুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করেই বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে। অবশ্যই মূল্যস্ফীতি নাগালের মধ্যেই থাকবে। আমরা সেভাবেই কাজ করছি। শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে খাদ্যখাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। তবে খাদ্য বহির্ভূত খাতে সেইভাবে বাড়েনি। শহরের তুলনায় গ্রামে খাদ্য আইটেম বেশি ব্যবহার হয়। এ কারণে মূলত শহরেরে তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। তবে, কীভাবে গ্রাম ও শহরে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা যায় সেই জন্য কাজ করছে সরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেয়া মার্চ মাসের ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) হালনাগাদ তথ্যে এমনটা বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে শহরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। একই সময়ে গ্রামে ছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ও ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। মার্চে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২২ শতাংশে, ফেব্রুয়ারিতে যা ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশে। খাদ্য খাতে এ সময় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ, গত মাসে যা ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ, তবে জানুয়ারি মাসে ছিল ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। ফলে জানুয়ারি মাস থেকে পর্যায়ক্রমে বেড়েই চলেছে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার। তবে খাদ্য বহির্ভূত খাতে মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার কমে ৬ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। প্রসাধন সামগ্রী, জুতা, পরিধেয় বস্ত্র, বাড়ি ভাড়া, আসবাবপত্র, গৃহস্থালি পণ্যে, চিকিৎসা সেবা, পরিবহন, শিক্ষা উপকরণ এবং বিবিধ সেবা খাতের মূল্যস্ফীতির হার মার্চ মাসে কম ছিল বলে দাবি বিবিএসের।

বিবিএস দেশের ১৪০টি বাজার থেকে পণ্য দামের তথ্য সংগ্রহ করে, যার মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১২টি বাজার রয়েছে। সংস্থাটির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গড়ে মার্চ মাসে দাম বেড়েছে চাল, আটা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও হলুদের। এ ছাড়া আলু, বেগুন, ঢেঁড়স ও পেঁপের মতো সবজির দামও বেড়েছে।

বিবিএস থেকে জানা গেছে, যেভাবে নিতপণ্যের দাম বাড়ছে সেইভাবে আয় বা মজুরি বাড়ছে না। ফলে মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ছেন ভোক্তা। খাদ্যপণ্য কিনতেই তাদের মজুরির বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে। গত তিন মাসের মধ্যে জানুয়ারিতে মজুরি বেড়েছে ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ ও মার্চে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে, এ তিন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে যথাক্রমে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ৬ দশমিক ১৭ ও ৬ দশমিক ২২ শতাংশ।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ