ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

দেশে সতেরো মাস পর সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি

প্রকাশনার সময়: ২০ এপ্রিল ২০২২, ১৩:৪৯

সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতির পারদ আরো চড়েছে। মার্চ মাসে ৬ দশমিক ২২ উঠেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। ১৭ মাস পর মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠল। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে এই হার ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে টানা ছয় মাস বাড়ার পর জানুয়ারিতে কমেছিল এই সূচক। ফেব্রুয়ারিতে তা আবার বাড়ছে।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) গত মার্চ মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। এর অর্থ হলো, ২০২১ সালের মার্চ যে পণ্য বা সেবার জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৬ টাকা ২২ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

এই মাসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে বেশি ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য বলছে, মার্চে শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে। গ্রামে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর শহরে হয়েছে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রাম এলাকায় পণ্যমূল্য বেড়েছে বেশি। তবে সরকার বা বিবিএসের দেয়া হিসাবের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বাস্তবে অনেক বেশি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার বিবিএসের দ্বিগুণের চেয়ে বেশি।

গত ৩ মার্চ ‘মূল্যস্ফীতি: সরকারি পরিসংখ্যান বনাম প্রান্তিক মানুষের বাস্তবতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সানেম। এতে বলা হয়েছে, শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখন ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর গ্রামে এই হার ১২ দশমিক ১০ শতাংশ।

প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘পণ্যমূল্য নিয়ে সরকারি সংস্থা বিবিএস যে তথ্য দিচ্ছে, তা বাস্তবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ ক্ষেত্রে যদি সঠিক তথ্য তুলে আনা না হয়, তবে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া টেকসই হবে না।’ নানা তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বিবিএস পুরোনো ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করছে, যা বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য না।’ সেলিম রায়হান বলেন, ‘নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ খুবই চাপে আছে। ভাত না খেয়ে অন্য কিছু খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছে অনেক মানুষ।’

একই কথা বলেন অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য বিস্ময়কর। এটা দেশের কোনো মানুষই বিশ্বাস করে না।’ বিবিএসের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, দেড় বছর পর গত বছরের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ‘ঘর’ অতিক্রম করে ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে ওঠে। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা কমে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে আসে।

২০২০ সালের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এর পর থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের নিচেই অবস্থান করছিল। চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, শাকসবজি থেকে শুরু করে মাছ-মুরগিসহ সব ধরনের প্রয়োজনীয় খাবারের দাম বৃদ্ধির কারণে মার্চে মূল্যস্ফীতি ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

এর আগে ২০২০ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ১২ মাসের গড় হিসাবে ডিসেম্বর শেষে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা নির্ধারিত লক্ষ্যের বেশ খানিকটা ওপরে।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এই লক্ষ্য ধরা ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু অর্থবছর শেষ হয় ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে। অর্থাৎ বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে খানিকটা বেশি ছিল গড় মূল্যস্ফীতি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করার পর থেকেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। তার প্রভাব পড়েছে ছোট-বড় সব দেশে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন আর্থিক সংস্থা পূর্বাভাস দিচ্ছে, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে।

শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি: পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, মার্চ মাসে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ২২ শতাংশের যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, তার মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক শুণ্য ৪ শতাংশ।

ফেব্রুয়ারিতে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ সার্বিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয় ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ১০ শতাংশ। মার্চে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি হয়েছে; এই মাসে গ্রামাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। মার্চ মাসে শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, মার্চ মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গ্রামে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে গ্রামে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।

মার্চ মাসে শহর এলাকায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে শহর এলাকায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ। শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি কেন- এ প্রশ্নের উত্তরে আহসান মনসুর বলেন, ‘আমার কাছেও অবাক লাগে, এটা কেন হয়। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে এখন অনেক পণ্যই দ্রুত গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে। সে ক্ষেত্রে গ্রামে পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

সে কারণে দাম বেড়ে যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, গ্রাম হোক আর শহরই হোক বাজারের বাস্তব প্রতিফলন বিবিএসের তথ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে না। সে কারণেই বিবিএসের তথ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ ক্ষেত্রে বিবিএসের তথ্য সংগ্রহে যদি কোনো সমস্যা থাকে, সেটা দূর করা প্রয়োজন।’

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ