ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

দাতা হয়ে বিপাকে

প্রকাশনার সময়: ১৩ এপ্রিল ২০২২, ০৮:০৭

শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখায় বাংলাদেশ। তবে এই নাম লেখানো সুখকর হলো না। বিদেশি ঋণ পরিশোধে অক্ষমতার কথা স্বীকার করেছে শ্রীলঙ্কা। ফলে এই ঋণ নিয়ে বিপাকে বাংলাদেশ। ঋণ পরিশোধের সময় বারবার বাড়িয়েও তা ফেরত পাওয়ার কোনো সুখবর নেই। ঋণ পরিশোধ না করেই উল্টো আরো ২৫ কোটি ডলার চেয়েছে দেশটি। দেশটি জানিয়েছেন, টিকে থাকতে তাদের আরো ৩০০ কোটি ডলার বৈদেশিক সহায়তা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ যদি স্বল্প সময়ে টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় ঋণ দিয়ে থাকে তাহলে পলিসি ও তথ্যগত মারাত্মক ভুল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এদিকে, ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হওয়া শ্রীলঙ্কা ৫১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের অক্ষমতা স্বীকার করেছে। খাবার এবং জ্বালানির তীব্র ঘাটতির পাশাপাশি দৈনন্দিন দীর্ঘসময় ধরে বিদ্যুৎবিহীন থাকা ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের এই দেশটিতে ব্যাপক ভোগান্তি তৈরি করেছে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর এবারই প্রথম চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। অর্থনৈতিক এই দুর্দশা দেশটির জনগণের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করেছে। এর মাঝেই ক্ষুব্ধ জনগণ দেশটির সরকারি নেতাদের বাড়িতে হামলার চেষ্টা করেছেন। প্রায় প্রত্যেকদিনই দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তা বাহিনী টিয়ার গ্যাস এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে।

গতকাল মঙ্গলবার দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অর্থনৈতিক সহায়তার আগে বিদেশি সরকারের কাছ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না শ্রীলঙ্কা।

মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের আর্থিক অবস্থার আরো অবনতি ঠেকাতে সরকার একেবারে শেষ অবলম্বন হিসেবে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।’ ঋণদাতারা তাদের বকেয়া যে কোনো পরিমাণ সুদ মূলধনের সঙ্গে যোগ করতে পারে অথবা শ্রীলঙ্কান রুপিতে পরিশোধের ব্যবস্থা নিতে পারে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারিতে পর্যটন এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্স খাত থেকে রাজস্বের পরিমাণ একেবারে তলানিতে ঠেকেছে শ্রীলঙ্কার। যে কারণে দেশটি বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য দেশটির সরকার আমদানির ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সরকারের অব্যবস্থাপনা, বছরের পর বছর ধরে ঋণ নিলেও পরিশোধের ব্যবস্থা না করা এবং অযৌক্তিক শুল্ক কাটছাঁট করার কারণে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে শ্রীলঙ্কা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, সরকারের চাপেই শতভাগ ঝুঁকি থাকার পরও ঋণ দিতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে যেহেতু আগে থেকেই জানা আছে শ্রীলঙ্কা কিস্তি পরিশোধের পর্যায়ে নেই। তাই সময় চাইলেই তা বাড়িয়ে দেয়ার নির্দেশনা দেয়া আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারে পরিষ্কার ছিল। তাছাড়া ঋণ বিতরণের পূর্বশর্ত হলো যাকে ঋণ দেয়া হচ্ছে তার পরিশোধের সক্ষমতা আছে কিনা সেটি যাচাই করা। কিন্তু যদি মানবিক দিক বিবেচনায় দেয়া হয়ে থাকে সেটি ভিন্ন কথা। তবে, যখন দিন দিন বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বোঝা ভারী হচ্ছে এমন প্রেক্ষাপটে অন্য দেশকে ঋণ দেয়া দেশের আর্থিক নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে যেটি পাওয়া যাচ্ছে তাতে ঋণের টাকা ফেরত পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হবে অন্তত ১৫ বছর। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ম্যাক্রো ইকোনমিক্স এক্সপার্টদের পর্যালোচনায় অতীতে সংকটে পড়া দেশগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর রেকর্ড এবং পরিস্থিতি উত্তরণে আইএমএফের তৈরি গাইডলাইন অনুসারে, শ্রীলঙ্কা এখন যে বড় সংকটে আছে তাতে তাদের অর্থনীতি স্থিতিশীল হতে পাঁচ থেকে আট বছর সময় লাগবে। এরপর আরো পাঁচ বছর রিজার্ভ বাড়াতে হবে।

পর্যাপ্ত রিজার্ভ জমা হলে আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী বড় দাতা গোষ্ঠীর ঋণ আগে পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে প্রথমে রয়েছে আইএমএফ, দ্বিতীয়ত ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, তৃতীয়ত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক —এডিবি। এরপর অগ্রাধিকার পাবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ঋণ। এছাড়া সভরেন বন্ডের এক বিলিয়ন ডলার শোধ করার পর বাংলাদেশ ও ভারতের ঋণ পরিশোধের বিষয়টি সামনে আসবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে ঋণের টাকা ফেরত পেতে অন্তত ১৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে বাংলাদেশের ঋণ ফেরত না পাওয়ার কোনো শঙ্কা নেই বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের দাবি ফেরত পেতে সময় লাগবে এটা ঠিক, কিন্তু টাকা না পাওয়ার কোনো শঙ্কা নেই। আইএমফের সাবেক কর্মকর্তা ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, সেন্ট্রাল ব্যাংক টু সেন্ট্রাল ব্যাংকের ঋণ হারিয়ে যাওয়ার কোনো রেকর্ড নেই। এটা খুব উচ্চ জাতের ঋণ। এটি ফেরত পেতে ১৫-২০ বছর অপেক্ষা করতে হবে এটা সত্য। তবে মুনাফাসহ ফেরত পাওয়া যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। যতদিন শ্রীলঙ্কা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে বা শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক টিকে থাকবে ততদিন টাকা হারিয়ে যাবে না।

এরমধ্যে ১৯ আগস্ট পাঁচ কোটি ডলার, ৩০ আগস্ট ১০ কোটি ডলার ও ২১ সেপ্টেম্বর পাঁচ কোটি ডলার ছাড় করা হয়। প্রথম কিস্তি পরিশোধ করার জন্য শ্রীলঙ্কাকে তিন মাস সময় দেয়া হয় এবং এ সময় সুদের হার নির্ধারিত ছিল লিবরের সঙ্গে অতিরিক্ত ২ শতাংশ। প্রথম তিন মাসে ঋণ শোধ করতে না পারলে শ্রীলঙ্কাকে আরো তিন মাস সময় দেয়া হয়। দ্বিতীয়বারের তিন মাসেও সুদের হার সমান থাকবে।

তবে ছয় মাস পার হলে সুদের হার নির্ধারণ করা হয় লিবরের সঙ্গে বাড়তি ২ দশমিক ৫ শতাংশ। লিবর হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বল্পমেয়াদে ঋণ দেয়ার জন্য প্রচলিত সুদের হার। বর্তমানে তিন মাস মেয়াদি লিবর হার হচ্ছে শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ আর ছয় মাস মেয়াদে লিবর সুদ হার হচ্ছে শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ। শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হওয়ার পর শ্রীলঙ্কার অনুরোধে ঋণের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। সে অনুযায়ী, তিন মাস পরপর প্রত্যেকটি কিস্তি রিনিউ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দুই দফায় রিনিউ করা হয়েছে। এরফলে প্রথম কিস্তিতে দেয়া পাঁচ কোটি ডলারের ঋণটির মেয়াদ পূর্তি হবে আগামী ১৮ মে। দ্বিতীয় কিস্তিতে দেয়া ১০ কোটি ডলারের ঋণটির মেয়াদ পূর্তি হবে ৩১ মে। আর সর্বশেষ কিস্তিতে দেয়া পাঁচ কোটি ডলারের ঋণটির মেয়াদপূর্তি হবে আগামী ২১ জুন।

এই সময় শেষ হলে আরো তিন মাস করে বাড়ানো হবে। এভাবে সময়ের সঙ্গে সুদের হিসাবে টাকার অঙ্ক বাড়ছে। কিন্তু ঋণ আদায়ে অগ্রগতির দেখা মিলছে না। কিস্তি শোধ না করে শ্রীলঙ্কার সরকার নতুন করে আরো ২৫ কোটি ডলার ধার চেয়েছে। সেটি আবার নতুন ঝুঁকি তৈরি করে কি-না তা নিয়ে সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী পদক্ষেপ চূড়ান্ত করবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাতে গত বছরে ঋণ সহায়তার জন্য বাংলাদেশের শরণাপন্ন হয়। দেশটি ডলারের সংকট মোকাবিলায় আমাদের কাছে ২৫ কোটি ডলার ঋণ চায়। কিন্তু আমরা ২০ কোটি ডলার ধার দিয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশটির পাশে দাঁড়ানো চেষ্টা করি। ‘কারেন্সি সোয়াপ’ ব্যবস্থায় ওই ঋণ পরিশোধের কথা ছিল তিন মাসের মধ্যে। লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেটের (লিবর) সঙ্গে ২ শতাংশ যোগ করে সুদের হার নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে একই সুদের হারে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানো হয়।

এ সময়েও কোনো অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় নতুন সুদহারের শর্তে ঋণ পরিশোধে আরো এক বছর সময় দেয়া হয়। কিন্তু দেশটির অর্থনীতিতে ধস নেমে আসায় ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কারণ সামর্থ্য না থাকলে ঋণ আদায় হবে কোথায় থেকে তা নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ ঋণ আদায়ের বিষয়ে রীতিমতো বিপাকে রয়েছি।’

বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী, শ্রীলঙ্কার বর্তমান ঋণের হার তাদের জিডিপির ১১৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশটি সবমিলিয়ে এক বছরে যে পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে, তার তুলনায় ঋণ বেশি। শ্রীলঙ্কার ঋণের ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডের। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে ঋণ ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ, জাপানের কাছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং চীনের কাছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য বলছে, ঋণের দায় পরিশোধ হিসেবে চলতি বছর শ্রীলঙ্কার সব মিলিয়ে ৫০০ কোটি ডলার পরিশোধ করার কথা। অথচ এখন তাদের হাতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আছে মাত্র ২৩১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, দৈনন্দিন কাজ চালাতেই নতুন করে ঋণ করতে হচ্ছে দেশটির।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ