ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

তাল মেলাতে হিমশিম সাধারণ মানুষ

ইফতারিতেও মূল্যস্ফীতির থাবা
প্রকাশনার সময়: ০৯ এপ্রিল ২০২২, ০৮:৫৪

রাজধানীর উত্তর বাড্ডার হোটেল ব্যবসায়ী মামুন। প্রতিবছরের মতো এবারো ইফতার বিক্রি করছেন তিনি। তবে গত বছর ১০০ টাকায় যে পরিমাণ ইফতার দিতেন, এবার সেই একই দামে পরিমাণ কমিয়ে এনেছেন। সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তাই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে পণ্যের সমন্বয় করতেই ইফতারির পরিমাণ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে জানিয়ে মামুন নয়া শতাব্দীকে বলেন, ইফতারি তৈরিতে সবধরনের উপকরণের দাম বেড়েছে। ফলে পরিমাণ কমিয়ে এভাবেই সমন্বয় করতে হবে। তা না হলে অনেকেই খেতে পারবে না।

এবার মামুনের ইফতারিতে থাকছে— বেগুনি, পিঁয়াজু, ছোলা, জিলাপি ও মুড়িসহ বিভিন্ন মুখরোচক খাবার। বিভিন্ন সাধারণ মানের ইফতারি আইটেমের দাম বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন অন্য রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরাও। জানা গেছে, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে পণ্য বা সেবার জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৬ টাকা ১৭ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। এই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে বেশি ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে। গ্রামে মূল্যম্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর শহরে হয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রাম এলাকায় পণ্যমূল্য বেড়েছে বেশি। তবে সরকার বা বিবিএসের দেয়া হিসাবের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বাস্তবে অনেক বেশি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ে বিবিএসের দেয়া তথ্য এক মাস আগের। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার আরো বেড়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা জানান, এখন খাদ্য ও খাদ্যপণ্য তৈরির উপাদানগুলোর স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম অনেক চড়া। আয় থেকে নিত্যপণ্যের দাম বেশি। এই দুইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে কষ্ট হওয়ায় ভোক্তারা এখন তাদের ব্যয় কমিয়ে ফেলছেন। এ পরিস্থিতিতে রেস্টুরেন্টগুলোতে ইফতার তৈরির যথেষ্ট আয়োজন থাকলেও খাবারগুলোর দাম চড়া। ফলে এবারের ইফতার-কেন্দ্রিক ব্যবসা কতটা লাভজনক হবে, তা নিয়ে শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা।

তৌকির আহমেদ নামের এক ভোক্তা নয়া শতাব্দীকে জানান, সবকিছুর দাম বেড়েছে, কিন্তু আয় বাড়েনি। ফলে ব্যয় কমানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। গত বছর থেকে এবার ইফতারির দাম অনেক বেশি। এই পরিস্থিতিতে খাওয়া কমানো ছাড়া আর কী উপায় আছে বলেন?

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, ‘ইফতার তৈরির বিভিন্ন উপাদানের দাম বেড়েছে। যে কারণে ইফতারের বিভিন্ন খাবারের দাম বাড়বে। অন্যদিকে, যখন জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে এমনিতেই মানুষ বেকায়দায়, তখন দাম বাড়ানো হলে ইফতারের ব্যবসা কতটা জমে উঠবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।’

মহাখালীর ইফতার সামগ্রী বিক্রেতা জালালউদ্দিন বলেন, নিত্যপণ্য ও ইফতার তৈরির বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যেই জিলাপির কেজি ১৮০ টাকা থেকে ২৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ যেগুলো গত বছর ৫ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে, সেগুলো হয়তো ৭-৮ টাকা অথবা আকারে ছোট করা হবে। অনেকে তো আবার দাম বেশি এবং ছোট দুইটাই করবে।

পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী শফিক আলাউদ্দিন বলেন, গত বছর জালি কাবাব বিক্রি করেছি ৩৫ টাকায়, এবার সেটা আরো বেশি দামে বিক্রি করতে হবে। কারণ গরুর মাংসের কেজি বেড়ে এবার ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশে ইফতারের ব্যয় নিয়ে তেমন কোনো জরিপ বা গবেষণা নেই। এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্যও নেই রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের কাছে।

তবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার ড. মামুন রশীদ ২০১৪ সালে ইফতারের অর্থনীতি নিয়ে একটি জরিপ করেছিলেন। ওই জরিপের সঙ্গে দেশের মানুষের বর্তমান সময়ের মূল্যস্ফীতি ও মানুষের ব্যয় কাঠামো মিলিয়ে একটি আর্থিক লেনদেনের একটি চিত্র তুলে ধরা যায়। ওই জরিপের সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমানে দেশে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশ মুসলমান।

প্রতিদিন অন্তত ১২ কোটি মানুষ ইফতার করেন। কেউ খরচ করেন ১০০ টাকা, কেউ আবার ২০ টাকা। সে হিসেবে গড়ে একজন মানুষ ৪০ টাকা খরচ করে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার বিবিএসের দেয়া তথ্যের দ্বিগুণের বেশি।

গত ৩ মার্চ ‘মূল্যস্ফীতি: সরকারি পরিসংখ্যান বনাম প্রান্তিক মানুষের বাস্তবতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সানেম। এতে বলা হয়, শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখন ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর গ্রামে এই হার ১২ দশমিক ১০ শতাংশ।

প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘পণ্যমূল্য নিয়ে সরকারি সংস্থা বিবিএস যে তথ্য দিচ্ছে তা বাস্তবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ ক্ষেত্রে যদি সঠিক তথ্য তুলে আনা না হয়, তবে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া টেকসই হবে না। বিবিএস পুরোনো ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করছে, যা বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য না। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ খুবই চাপে আছে। ভাত না খেয়ে অন্যকিছু খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছে অনেক মানুষ।’

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ