ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

আমদানির চাপে অর্থনীতি

প্রকাশনার সময়: ০৬ এপ্রিল ২০২২, ০৯:৩৯

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় দেশে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৫ হাজার ৯৪৫ কোটি (৫৯.৪৬ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি। বিষয়টি নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছে অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, ৫০ শতাংশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা আমাদের অর্থনীতির নেই।

বর্তমান বিনিময়হার হিসেবে (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ২০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৫ লাখ ১২ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৮৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে এমন দেখা যায়নি। আর এতে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও চাপের মধ্যে রয়েছে। যদিও মার্চ মাসে বেড়েছে প্রবাসীদের আয়। এই পরিস্থিতিতে আমদানির লাগাম টানার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলছেন, অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে সরকার ও দেশবাসীকে অনুরোধ করেছেন তিনি। সবাইকে সাশ্রয়ী হতে বলেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক পণ্য আমদানির এলসিসংক্রান্ত হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, এই সাত মাসে গড়ে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় সেসব দেশের মানুষ আগের মতো পণ্য কেনা শুরু করেছেন। দেশের পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সব মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সব ধরনের পণ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে গেছে। সে চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা নতুন উদ্যমে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সে কারণেই শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ (ক্যাপিটাল মেশিনারি) সব ধরনের পণ্য আমদানিই বেড়ে গেছে; বেড়েছে এলসি খোলার পরিমাণ।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ অন্য সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এলসি খুলতে বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে বলে জানান তারা। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য আমদানির জন্য ৬ হাজার ৭০৪ কোটি (৬৭.০৪ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছিলেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। ওই অঙ্ক ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে এলসি খুলতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা খরচ হয়েছে রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল কাপড় ও অন্য পণ্য আমদানিতে; সেটা ৮৫০ কোটি ৫৪ লাখ (৮.০৫ বিলিয়ন) ডলার, গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ৪৭ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি।

সুতা আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৩৪১ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১০ শতাংশ। তুলা ও সিনেথেটিক ফাইবার আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ২৮৭ কোটি ২২ লাখ ডলারের। বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। রাসায়নিক দ্রব্য ও সার আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৩৭০ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। এ ছাড়া ওষুধের কাঁচামালের এলসি খোলা হয়েছে ৭৮ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের; বেড়েছে ১৮ দশমিক ১৪ শতাংশ।

মূলধনি যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির জন্য ৪৬৫ কোটি ২৮ লাখ ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৫৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ২৫২ কোটি ৫৭ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, ১০৫ দশমিক ১৪ শতাংশ।

খাদ্যপণ্যের মধ্যে চাল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৩২ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের; কমেছে ১৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। গম আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১৪৪ কোটি ১২ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ। চিনি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৭৪ কোটি ৮২ লাখ ডলারের। প্রবৃদ্ধি ৯৩ শতাংশ। ভোজ্যতেল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১৪২ কোটি ৬২ লাখ ডলারের; বেড়েছে ৬৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অন্যান্য পণ্য ও শিল্প যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১ হাজার ৫৫০ কোটি ৬৯ ডলারের; বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ৩৯ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল।

২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট ৫৬ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল, যা ছিল আগের (২০১৮-১৯) অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ২১ শতাংশ কম।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, অনেক হয়েছে আর নয়। যে করেই হোক আমদানি কমাতেই হবে। এছাড়া এখন আর অন্য কোনো পথ খোলা নেই। সাধারণভাবে অর্থনীতিতে আমদানি বাড়াকে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়ে থাকে। বলা হয়, আমদানি বাড়লে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে। এতদিন আমরাও সেটা বলে আসছি। কিন্তু এখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ৫০ শতাংশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা আমাদের অর্থনীতির নেই। এখন এটা কমাতেই হবে। তা না হলে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়ব আমরা। তিনি বলেন, দাম বাড়ায় সরকারের জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কয়েকগুণ বেড়েছে গেছে। একইসঙ্গে গ্যাসে ভর্তুকি বেড়েছে, সারে বেড়েছে। বিদ্যুতে বেড়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এবার ভর্তুকি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বাজেট ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপ পড়বে।

এক প্রশ্নের উত্তরে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর বলেন, ‘সরকারকে সাশ্রয়ী হতে হবে। একই সঙ্গে দেশের মানুষকেও সংকটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কম খরচ করতে হবে। আমাদের অনেক কিছুই কিন্তু জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার, পানি— এসব কিছু উৎপাদনে তেলের প্রয়োজন হয়। এই সংকটের সময়ে এসব কিছু যদি মানুষ কম ব্যবহার করে। পরিবহন খাতে যদি জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমানো যায়, তাহলে আমদানি খাতে খরচ কমবে। সরকারের ভর্তুকি কমবে। অন্যদিকে বিলাসবহুল পণ্য যাতে কম আমদানি হয়, সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। প্রয়োজন নেই এমন পণ্য আমদানি থেকে এখন বিরত থাকতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি দিক-নির্দেশনা দেয়া উচিত বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল তেলের দাম। একপর্যায়ে প্রতি ব্যারেলের দর ১৩৯ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। এখন বিশ্ববাজারে তেলের দর নিম্নমুখী। তাও ১০০ ডলারের উপরে অবস্থান করছে।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ