ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিত্যক্ত চার পণ্যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন

প্রকাশনার সময়: ০৩ এপ্রিল ২০২২, ১২:৫৭

একসময় ছিল পরিত্যক্ত পণ্য, যেটা ব্যবহার শেষে ফেলে দিত সাধারণ মানুষ, এ রকম চার পণ্যই এখন সৌভাগ্যের উপলক্ষ নিয়ে এসেছে। এসব পণ্যে বৈদেশিক মুদ্রা আসতে শুরু করেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের অভিনব এ চারটি পণ্য হলো— মাছের আঁশ, সেলুন থেকে চুল, পরিত্যক্ত সুতা-কাপড় এবং ছাই। বিদেশের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে রীতিমতো শিল্প আকারে এসব পণ্যের সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানির ব্যবসা শুরু হয়েছে। লাখো মানুষ এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। অথচ এসব ব্যবসার বেশিরভাগই বাংলাদেশে শুরু হয়েছে গত দুই দশকের মধ্যে। করোনাভাইরাসের কারণে অনেকটা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মতো রফতানিমুখী এসব ব্যবসায় বড় ক্ষতি হলেও এখন আবার সেটা কাটিয়ে উঠছেন উদ্যোক্তারা।

মাছের আঁশ: মাছে-ভাতে বাঙালি হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশের মানুষের কাছে মাছ বরাবরই জনপ্রিয় থাকলেও, মাছের আঁশের কোনো কদর ছিল না। কিন্তু প্রায় দেড় দশক আগে থেকে এই ফেলে দেয়া পণ্যটি রফতানি আয় আনতে শুরু করেছে। এখন বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকার বেশি মাছের আঁশ সাত-আটটি দেশে রফতানি হয়। দুই হাজার আট সালে মাছের আঁশ রফতানির ব্যবসা শুরু করেন ঢাকার যাত্রাবাড়ীর শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘সেই সময় আমার একজন বন্ধু সিঅ্যান্ডএফের এজেন্ট ছিল। তার একজন জার্মান ক্রেতা তাকে বললেন যে, আমাদের মাছের আঁশ লাগবে, দেখো তো তোমরা এটা রফতানি করতে পারো কিনা। সেই বন্ধুর কাছ থেকে পরামর্শ পেয়ে আমি আঁশ সংগ্রহ করার কাজ শুরু করি।’ যদিও প্রথম দিকে মানুষ এ ব্যাপারে সচেতন না হওয়ায় পুরো এক বছর চেষ্টার পর মাত্র ৬০ টন আঁশ সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। এরপর আস্তে আস্তে সারাদেশে তাদের একটি সাপ্লাই চেইন গড়ে ওঠে। এখন বাংলাদেশ থেকেই প্রতি বছর প্রায় আড়াই হাজার টন আঁশ রফতানি হয় জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোয়। সেখানে মাছের আঁশ থেকে কোলাজেন ও জিলেটিন তৈরি করা হয়। ওষুধ, প্রসাধন সামগ্রী, ফুড সাপ্লিমেন্ট তৈরি মাছের আঁশ ব্যবহূত হয়। এছাড়া কোলাজেন ও জিলেটিন মাছের আঁশ দিয়ে তৈরি হয়, যা ওষুধ ও প্রসাধন সামগ্রীতে কাজে লাগে।

বাতিল সুতার বিশাল ব্যবসা: বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নানা আনুষঙ্গিক ব্যবসার জন্ম হয়েছে। এমনকি এই শিল্পের বাতিল পণ্যের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে বিশাল ব্যবসা, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। নওগাঁ, বগুড়া ও জয়পুরহাটের তিনটা জেলায় বাতিল সুতার ওপর ভিত্তি করে বিশাল কুটির শিল্প তৈরি হয়েছে। বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার নসরতপুর ইউনিয়নের শাওল বাজারে শুধু এসব পরিত্যক্ত সুতার বিশাল একটি বাজার তৈরি হয়েছে। এ এলাকায় কোন কোন রঙের চাহিদা আছে, সেগুলো আলাদা করে রাখা হয়। অন্যান্য রঙের যেসব সুতা বাকি থাকে, সেগুলোকে আবার ডায়িং বা রং করার জন্য পাঠানো হয়। এরপর এসব সুতা কিনে নেন এসব জেলার তাঁতিরা। তারা চরকা বা নাটাইয়ের সাহায্যে আলাদা আলাদা করা হয়। এরপর কেজি আকারে বিক্রি হয়। এসব সুতা ১২০ টাকা থেকে শুরু করে মান ভেদে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।

ছাই থেকে বৈদেশিক মুদ্রা: ‘উড়িয়ে ছাই পেলেও পেতো পারো অমূল্য রতন’ এদেশে এ প্রবাদ চালু থাকলেও, ছাই বিক্রি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব, দুই দশক আগে সেটা কেউ চিন্তাও করেনি। কিন্তু শুধু ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ছাই রফতানি করেই বাংলাদেশের আয় হয়েছে তিন কোটি ২১ লাখ ৮৭ হাজার ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা। তবে রফতানিযোগ্য ছাইয়ের কয়েকটি ধরন রয়েছে।

ইস্পাত কারখানাগুলোয় চুল্লির ধোঁয়া আটকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছাইয়ে রূপান্তর করা হয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি কোম্পানি বিএসআরএম প্রথম এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে। একে স্টিল ডাস্টও বলা হয়। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য শুরু করলেও পরবর্তীতে লাভজনক ছাই রফতানিতে পরিণত হয়। এখন প্রায় বড় ইস্পাত কোম্পানি এই ব্যবসায় জড়িত হয়েছে। চীন, ভারত, স্পেন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ইত্যাদি দেশে এই ছাই রফতানি হয়। এগুলো মূলত কালি ও প্রিন্টারের কার্টিজ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। এর বাইরে পাটকাঠি থেকে তৈরি করা অ্যাকটিভেটেড চারকোলও তৈরি হচ্ছে এবং চীনে রফতানি শুরু হয়েছে। রাজশাহী, গাজীপুর, রাজবাড়ী, জামালপুর, পাবনা, ফরিদপুরে বাণিজ্যিকভাবে চারকোল তৈরি করা হচ্ছে। এসব চারকোলে থাকা কার্বনের বিদেশে চাহিদা রয়েছে। এ দিয়ে ফটোকপির ও প্রিন্টারের কালি, ওষুধ, দাঁত পরিষ্কারের সামগ্রী, পানির ফিল্টার তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে আরেক ধরনের ছাই পাড়া-মহল্লায় বিক্রি হয়। মাছ কাটা, থালাবাসন মাজা ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা এসব ছাই তৈরি হয় মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন চাল কলে। সেখানে তুষের ছাই পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে আনেন। ডেমরা ও কাওরানবাজারে এ রকম তুষের ছাইয়ের পাইকারি বাজার রয়েছে। ছাই বিক্রেতা মতিউর রহমান বলেন, ‘মাছ কাটতে, ঘরবাড়ির বাসন মাজতে ছাই লাগে। আমরা মুন্সীগঞ্জ থেকে এনে পাইকারি বিক্রি করি। প্রতি বস্তা ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে।’

ফেলে দেয়া চুলের ব্যবসা: স্যালুন বা পার্লারে গিয়ে চুল কাটানো বহু পুরোনো ঘটনা হলেও, সেই কাটানো চুল বা ফেলে দেয়া চুল হয়ে উঠেছে অনেকের জীবিকার উৎস। শুধু দেশের বাজারেই নয়, এসব চুল থেকে প্রতি বছর শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রাও আসছে। এসব চুল দিয়ে উইগ বা পরচুলা তৈরি করা হয়। বাংলাদেশেই এখন উইগের কারখানা তৈরি হয়েছে। ঢাকার কলাবাগানের একটি বিউটি পার্লারের মালিক তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘বড় চুল কাটা হলে মেয়েরা সংগ্রহ করে রাখে। প্রতি সপ্তাহেই লোকজন এসে এই চুল নিয়ে যায়। আমরা আগে ঝাড়ু দিয়ে চুল ফেলে দিলেও এখন অবশ্য সংগ্রহ করে রেখে দেই।’ ঢাকার খিলগাঁওয়ে পরচুলা তৈরির একটি কারখানা রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন স্যালুন বা বিউটি পার্লার থেকে সংগ্রহ করা চুল দিয়ে পরচুলা বা উইগ তৈরি করা হয়। হেয়ারি উইগের মালিক মতিউর রহমান ২২ বছর আগে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তখন দোকানে দোকানে গিয়ে তিনি ফ্যাশন ডলের মাথায় উইগ বসানোর জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতেন। আর এখন তার কাছে প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছেন উইগের খোঁজে। কাটা চুল কেজি প্রতি তিন-চার কিংবা ৫০০০ টাকাতেও বেচা-কেনা চলছে। তবে চুলের আকার হতে হবে আট ইঞ্চি লম্বা। বর্তমানে কোনো কোনো কোম্পানি এই চুল আইল্যাশ বা চোখের পাপড়ি তৈরিতে ব্যবহার করছে। আর বিভিন্ন বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা চুল প্রক্রিয়াজাত করা ছাড়াও চলে যাচ্ছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। শতকোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আসছে ফেলনা এসব চুল রফতানি করে। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি এ ধরনের চুল যাচ্ছে ভারতে। রাজশাহী, নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গাসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক জায়গাতে ফেলে দেয়া চুল হয়ে উঠেছে অনেকের রোজগারের উৎস। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তালিকায় উইগ এবং হিউম্যান হেয়ারকে অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে বলা হচ্ছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৫৫ লাখ ডলারের বেশি এ ধরনের পণ্য রফতানি হয়েছে। বিবিসি বাংলা।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ