শবেবরাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে কেজি প্রতি এক হাজার টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে গরুর মাংস। এখন ৬৫০-৭০০ টাকার নিচে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। গরুর মাংসের দামে যা রেকর্ড। মাংসের এত দাম আগে কখনো দেখা যায়নি। এদিকে, নিম্নবিত্তের খাবার তালিকা থেকে বহু আগেই বাদ পড়েছে গরুর মাংস। মধ্যবিত্তের এখন কিনে খেতেও ত্রাহি অবস্থা। তবে উচ্চবিত্তের আগ্রহের শীর্ষে গরুর মাংস। এই দাম বৃদ্ধির কারণ জানেন না কেউ। দাম কমা নিয়ে সংশয় সাধারণ ভোক্তাদের।
তারা বলছেন, শবেবরাত থেকে বেড়ে যাওয়া গরুর মাংসের দাম আর কমবে না। কারণ, এই দেশে কোনো জিনিসের দাম একবার বাড়লে আর কমে না। তবে ঠিক কোন কারণে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে তা জানেন না কেউই।
জানা গেছে, রাজধানীর বাজারগুলোতে এখন প্রতিকেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়। গত এক সপ্তাহ আগেও যা বিক্রি হয়েছে ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকায়।
ব্যবসায়ীরা জানান, নিম্ন আয়ের মানুষের গরুর মাংস কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। মধ্যবিত্তের যা ছিল তাও এখন নিভু নিভু অবস্থা। উচ্চবিত্তরাই এখন গরুর মাংসের মূল ক্রেতা। এক কেজি মাংস ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দিয়ে কেনার সামর্থ্য রাখে এমন মানুষ এখন হাতেগোনা। কারণ, চার থেকে পাঁচ সদস্যের পরিবারের জন্য এক কেজি মাংস কেনা অসম্ভব। বিক্রেতারাও এখন আর এক কেজি মাংস বিক্রি করতে চান না। এ ক্ষেত্রে কম পক্ষে দুই কেজি মাংস কিনতে ১৩শ’ থেকে ১৪শ’ টাকার প্রয়োজন হয়। এমন সামর্থ্যবান মানুষের সংখ্যা কমেছে। মাঝারি আয়ের চাকরিজীবীদের রান্নাঘরে গরুর মাংসের প্রবেশও মাঝে মধ্যে ঘটে। দরিদ্র মানুষের ভরসা শুধুই ঈদুল আজহা।
মাংস কিনতে এসে দেখে অবাক কাইয়ুমুজ্জামান সাগর। তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, আগের মতো এখন আর মাংস কিনে খাওয়া সম্ভব না। মাঝে মধ্যে কিনতে আসি। যখনই আসি তখনই দেখি দাম বেড়েই চলেছে। কমার কোনো নাম নেই, শুধু বাড়ছেই। এখন সব জিনিসেরই দাম বেশি। চাল, ডালসহ অন্যপণ্য কিনতে গিয়ে পকেটের সব টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই মাংস খাওয়া এখন বিলাসিতা ছাড়া কিছুই না। আর এসব দেখারও কেউ নেই।
মাংস বিক্রেতা জাকির জানান, শবেবরাতে মাংসের দাম এক দফা বেড়েছে। তারপর থেকে আর কমেনি। আমরা পাইকারি বাজার থেকে আনি। তাই একটু বেশি দামে বিক্রি করি। কাস্টমারও কম। গরু জবাই করতে পারলে দাম কম পড়ত। দুই সপ্তাহ ধরেই গরুর মাংসের দাম বেশি। রোজায় মাংসের চাহিদা একটু বেশি থাকে।
কারওয়ান বাজারের মাংস বিক্রেতা মোতালেব বলেন, ‘৫২ বছর ধইরা এখানে মাংস বেচতাছি। দিন দিন অবস্থা খারাপ হইতাছে। দাম যেভাবে বাড়তাছে, বেইচা শান্তি পাই না। কাস্টমাররে কী কমু, আমারো মাংস কিনে খাওয়ার ক্ষমতা নাই।’ মাংস ব্যবসায়ীরাও লোকসান দিচ্ছেন দাবি করে মোতালেব বলেন, ‘চার মাস ধরে ব্যবসায় লোকসান দিতেছি। এখানে সিন্ডিকেট হইয়া গেছে। লাভ করে বেপারি ও ফড়িয়ারা। আগে বেপারিরা (হাটে) যাইয়া গরু কিনত। হ্যাগো কাছ থেকে আমরা নিতাম; দাম কম পড়ত।’
তিনি বলেন, ‘এখন বাজার থেকে ফড়িয়ারা কিনে। তাগো কাছ থেকে বেপারিরা কিনে। তাগো কাছ থেকে আমরা কিনি। হাত বদলাইলেই তো দাম বাড়ে। কী হইতেছে আমরাই বুঝি না।’ আরেক বিক্রেতা মোহাম্মদ জালাল বলেন, ‘মাংসের দাম সাংঘাতিক বাড়ছে। বাজারে ভুসিসহ গরু-ছাগলের খানার দাম যেভাবে বাড়ছে, খামারিরা কিনতে পারছে না। তারা না পাললে বাজারে গরু আইব ক্যামনে? আমরা পামু কই? কাস্টমার খাইব ক্যামনে?’
জানতে চাইলে গাবতলী বাজারের গরু ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন বলেন, ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধ। খামারিরা এখন গরু বিক্রি করতে চায় না। কারণ, তিন মাস পরই কোরবানি। তারা খামারে লালন পালন করা গরু বিক্রির জন্য কোরবানির বাজার ধরতে চায়। এ কারণে বাজারে গরুর সরবরাহ কমেছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ঢাকায় ২০১৪ সালে এক কেজি গরুর মাংসের গড় দাম ছিল ৩০০ টাকা। ওই সময় মাঝারি আকারের দেশি মুরগির প্রতি কেজি দাম ছিল ৩১৭ টাকা। ২০১৮ সালের সর্বশেষ হিসাবে, দেশি মুরগির গড় দাম ৩৫২ টাকায় ওঠে, আর গরুর মাংসের গড় দাম ৫২৭ টাকায় ঠেকে। ক্যাবের হিসাবে, গত অক্টোবরে গরুর মাংসের গড় দাম ছিল প্রতি কেজি ৫৫০ টাকা। ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ার পর গত চার বছরে বাংলাদেশে অনেক গরুর খামার হয়েছে। তরুণদের অনেকে বড় খামার করে উদ্যোক্তা হয়েছেন। সরকার দাবি করছে, নিজেদের গরুতেই ঈদুল আজহার বিপুল চাহিদা মিটছে। তবে তা দিয়ে বছরের অন্য সময়ের চাহিদার কতটুকু মিটছে তা অবশ্য অনেকটাই অদৃশ্য রয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে এখন গরুর সংখ্যা দুই কোটি ৮৫ লাখের মতো। ২০১৮ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর হিসাব দিয়েছিল, তখন গরুর সংখ্যা দুই কোটি ৩৯ লাখ ছিল। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব শাহ ইমরান বলেন, পশুখাদ্যের দাম খুবই চড়া। বাণিজ্যিকভাবে পশুখাদ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে দাম নাগালে না আনলে খামারে গরু পালন লাভজনক হবে না। আর লাভজনক না হলে খামারিরা নিরুৎসাহিত হবেন। এতে গরুর উৎপাদন কমবে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ