রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাবে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি— এমন আশঙ্কা অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের।
তাদের মতে, যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে এর দাম বেড়ে গিয়ে চাপের মুখে ফেলছে সাধারণ মানুষকে। ইউক্রেন এবং রাশিয়ার এই যুদ্ধে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপরও প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাশিয়া যদি তেল রফতানি বন্ধ করে দেয়, তবে এই দাম আরো চড়বে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পে কাজ করছে রাশিয়া। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সামরিক সরঞ্জাম, খাদ্যপণ্য ইত্যাদি রাশিয়া থেকে আমদানি করে থাকে। তাছাড়া এখন তৈরি পোশাক শিল্পের নতুন বাজার হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে রাশিয়াকে। কিন্তু ইউক্রেনের ওপর হামলার জের ধরে রাশিয়ার ওপর বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। এরই মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঝাঁকুনি পড়তে শুরু করেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের ভেতর জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় না করে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা থেকে স্বল্পমেয়াদে ঋণ নিয়ে বাড়তি ব্যয় সামাল দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া, ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলোর এই সংঘাতে বাংলাদেশে তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘ মেয়াদের হলে এর নেতিবাচক প্রভাব গভীর হবে। ফলে এই সংকটের কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
যুদ্ধ দীর্যায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী কিছু প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। গম আর জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। প্রত্যাশা করা হয়েছিল, এ বছরের মাঝামাঝি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ৬৫ থেকে ৭০ ডলারে নেমে আসবে। কিন্তু এই সংঘাতের কারণে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম আরো বেড়ে গেলে টাকার মান কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে থেকে রাশিয়ায় রফতানি হয়েছে, ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য, টাকার অঙ্কে প্রায় ৫ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। এই রফতানির মধ্যে তৈরি পোশাক সবচেয়ে বেশি। এ সময়ে আমদানি হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য (প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা), যার বেশিরভাগই খাদ্য পণ্য। এর আগের বছর রাশিয়ায় বাংলাদেশ রফতানি করেছিল ৪৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য। আমদানি হয়েছে ৭৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। বিশেষ করে গমের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ভুট্টার ২০ শতাংশ আসে এই দুইটি দেশ থেকে। তৈরি পোশাক রফতানির নতুন বাজার হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে রাশিয়াকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের প্রভাব এর মধ্যেই তাদের ব্যবসার ওপর পড়তে শুরু করেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে রেকর্ড অবস্থানে পৌঁছেছে জ্বালানি পণ্যের মূল্য। নতুন করে দেখা দিয়েছে সরবরাহ বিচ্ছিন্নতা। সরকারের কিছু সময়োচিত পদক্ষেপের কল্যাণে স্বল্পমেয়াদে বাংলাদেশের জ্বালানি আমদানি প্রভাবিত না হলেও; যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তা বড় রকমের আর্থিক ও সরবরাহ সংকটের হুমকি সৃষ্টি করবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া, ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলোর এই সংঘাতে বাংলাদেশে তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলছেন, ‘এর আগে যখন ডিজেলের দাম বাড়ানো হলো, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ছিল ৮০ ডলার। বর্তমানে সেখানেই ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন তেলের দাম যে হারে বেড়েছে, যুদ্ধের কারণে সেটা আরো বাড়তে পারে।’
আমদানি ও রফতানি নিয়ন্ত্রণ দফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ১১০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়ে থাকে। রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে গম। ইউক্রেন থেকেও এই পণ্যটি বাংলাদেশ আমদানি করে। এর বাইরে তুলা, সরিষা ও মসুর ডাল রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করা হয়।
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বাংলাদেশের গমের মোট চাহিদার এক তৃতীয়াংশ আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। প্রতি বছর এই দুইটি দেশ থেকে প্রায় একশ’ কোটি টন গম বাংলাদেশে আসে। কিন্তু এই যুদ্ধের কারণে গমের সেই সরবরাহ নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর জারি করা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরাসরি এসব পণ্য কেনা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। যুদ্ধের কারণে এর মধ্যেই গম, সূর্যমুখী তেল আর ভুট্টার দাম বাড়তে শুরু করেছে। গম থেকেই ময়দা, আটা, সুজিসহ বিভিন্ন খাদ্যজাত পণ্য তৈরি করা হয়। মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের বেকারি ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘গমের দামে তো আর সরকারি ভর্তুকি থাকে না। এখন আমাদের বেশি দামে কিনতে হলে রুটি, বিস্কুটের দামও বাড়িয়ে দিতে হবে।’
মোহাম্মদপুরের টাউন হলের একজন ক্রেতা আঁখি আক্তার বলছেন, সূর্যমুখী তেলের দামও বেড়ে গেছে। গত মাসেও যে দামে কিনেছি, এই মাসে দুশ’ টাকা বেশি দিয়ে পাঁচ লিটারের জার কিনতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি কারক ও কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলছেন, ‘আমরা এর মধ্যেই চিন্তায় পড়ে গেছি। কারণ সুইফট সিস্টেম থেকে রাশিয়াকে বাদ দেয়া হলে আমাদের পাওনা পাওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে। আবার রাশিয়ায় যদি জাহাজ বা বিমান পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে তো এখানে তৈরি করা পোশাকও তো আমরা পাঠাতে পারব না।’
তিনি জানান, তেলের অব্যাহত দাম বৃদ্ধির কারণে তারাও চিন্তায় রয়েছেন। কারণ এর ফলে জাহাজ ভাড়া বাড়ছে। অন্যদিকে, যে দামে তারা পোশাক রফতানির আদেশ নিয়েছেন, সেখানেও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, এসবের বাইরেও বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাশিয়া অর্থায়ন এবং নির্মাণে সহায়তা করছে। এরই মধ্যে এই প্রকল্পের প্রথম ধাপ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রকল্পে রাশিয়া থেকে নেয়া ঋণও বাংলাদেশ পরিশোধ করছে। কিন্তু রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞায় প্রকল্পের সরঞ্জাম আনা বা ঋণ পরিশোধে সমস্যা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এ রাশিয়ার সহায়তার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, তাতে এসব প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রাশিয়া থেকে ইউরোপের গ্যাস সরবরাহ এখনই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে, এমন সম্ভাবনা কম। তবে এই সরবরাহে সামান্য ব্যাঘাত ঘটলেও বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। মহামারির কারণে বৈশ্বিক সংরক্ষিত গ্যাসের পরিমাণ ইতোমধ্যে অনেক কম, এখন নতুন করে সরবরাহ কমে গেলে বৈশ্বিক উৎপাদন অনেকটাই কমে যাবে। এতে শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাবে পড়বে ভোক্তাদের ওপর। মহামারি থেকে উত্তরণের এ সময়ে এলএনজি ও তেলের সরবরাহ ব্যাহত হলে- বাংলাদেশের শিল্প আর রফতানিও ব্যাহত হবে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম এখনই ব্যারেল প্রতি ১১১ ডলার অতিক্রম করেছে- যা ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া যদি তেল রফতানি বন্ধ করে দেয়, তবে এই দাম আরো চড়বে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘কতদিন যুদ্ধ চলবে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। তবে যুদ্ধ চলতে থাকলে সরকারকে বিপুল পরিমাণ টাকা জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে হবে। আমরা আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ করছি। আশা করি, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে না।’ জ্বালানির জন্য মধ্যপ্রাচ্য এবং এশীয় দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল হওয়ায়, বাংলাদেশ এই সংকট থেকে আপাতত নিরাপদে- তবুও ভবিষ্যতে হয়তো সংকটের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে। ডেলিভারি পেতে দেরি হওয়ায় বেসরকারি অপারেটরদের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের পরিচালক আজম জে চৌধুরী বলেছেন যে, তারা এরমধ্যেই শিপমেন্টে দেরি লক্ষ করছেন।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের মোট গ্যাস উৎপাদনের ১২.২ শতাংশ করে রাশিয়া, আর রফতানিতে দ্বিতীয়। দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে সরবরাহ কমেছে এবং চাহিদা বেড়েছে। তাই, ডেলিভারি পেতে দেরি হচ্ছে।’ সরবরাহ সমস্যা ছাড়াও যুদ্ধের কারণে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি বাংলাদেশের সাধারণ ভোক্তারাও অনুভব করবে। ডেলিভারি বিলম্বিত হওয়ার কারণে সরবরাহ ব্যাহত হলেও স্থানীয় সরবরাহে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না জানিয়ে ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের পরিচালক আজম জে চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশি অপারেটররা সিংহভাগ এলপিজিই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আমদানি করে।
ওরিয়ন গ্যাস লিমিটেডের হেড অব অপারেশন অনুপ কুমার সেন বলেন, সৌদি সিপি রেট অনুসারে, প্রোপেন ও বিউটেনের দাম ফেব্রুয়ারির চেয়ে প্রতি টনে ১৩৭.৫ ডলার বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে প্রতি টনের সৌদি সিপি রেট ছিল ৭৭৫ ডলার, যা এখন বেড়ে ৯১২.৫ ডলার হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বাজারে ঘাটতির কারণে তারা সময়মতো সরবরাহ পাচ্ছেন না।
চাহিদা-সরবরাহ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে জ্বালানি আমদানির দায়িত্বে থাকা সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এখনই সরবরাহ বিঘ্নিত হবে বলে মনে করছেন না তারা। বিপিসি চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বলেন, তেলের দামের ওপর প্রভাব পড়বেই। এ প্রভাব এড়াতে পারবে না বাংলাদেশের মতো আমদানিকাররা। লোকসান সমন্বয়ের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে এবিএম আজাদ বলেন, যেহেতু ২০২১ সালের নভেম্বরে সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির পর তারা আর দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেননি, তাই তারা তাদের নিজস্ব সক্ষমতা দিয়ে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করছেন। দৈনিক সরবরাহ ছাড়াও দেশে জ্বালানি তেলের মোট ৩৫-৪০ দিনের মজুদ সক্ষমতা রয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ