ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

এক সয়াবিনে প্রশ্ন অনেক

প্রকাশনার সময়: ০৫ মার্চ ২০২২, ১০:১৮

ভোজ্যতেল নিয়ে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। ঘোড়দৌড়ের মতো বাড়ছে দাম। সাধারণ ভোক্তাদের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার পরও বাড়ছে দাম। কেন বারবার বাড়ছে দাম— এ নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। গত ৬ ফেব্রুয়ারি লিটারপ্রতি ৮ টাকা দাম বাড়ানোর পর মাস শেষ না হতেই আবারো ১২ টাকা বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু ব্যবসায়ীদের। সরকার তাতে সায় না দিলেও দাম বেড়েছে বাজারে। তৈরি হয়েছে কৃত্রিম সংকট। অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি ভোজ্যতেল বিক্রি করছে ২০০ টাকায়! সরকারের তরফে অভিযান শুরু হলেও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সঙ্গে কার্যত পেরে উঠছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কথা বললেও প্রতিবেশী দেশ ভারতে বাংলাদেশের থেকে অনেক কম দামে বিক্রি হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর বেফাঁস কথায় বিরক্ত সবাই। তিনি যতটা না জনগণের প্রতিনিধি, কথাবার্তায় তার চেয়েও বেশি— ব্যবসায়ী।

এদিকে, ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে বাজারে বেড়ে গেছে দাম। ১৯০ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে খোলা সয়াবিন তেল। ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবে সরকার সায় না দেয়ায় বাজার থেকে রাতারাতি উধাও সয়াবিন তেল। সরকারি অভিযানের খবরে কিছু তেল বাজারে ফিরলেও তা নিয়ে ভোক্তাদের অভিযোগের শেষ নেই। ব্যবসায়ীদের একটি অসাধু সিন্ডিকেট চক্র কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জনগণকে জিম্মি করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বাজারে পামওয়েল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খুচরা বিক্রেতারা পামওয়েলই সয়াবিন বলে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ ভোক্তাদের। জানা গেছে, দেশে যে পরিমাণে সয়াবিনের দরকার হয় তার ৭০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। চাহিদা ও দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে আমদানি-রিফাইনের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। এদিকে, তেলের আমদানি নিয়ে দুই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১১ লাখ টন, যার ৭০ শতাংশই আমদানি করা হয়। বাংলাদেশে ভোজ্যতেল উৎপাদন হয় সাড়ে তিন লাখ টনের মতো। অন্যদিকে কাস্টমস ও আমদানি সংশ্লিষ্টদের তথ্যে দেখা যায়, দেশে বছর পাঁচেক আগে সয়াবিন, পাম ও ক্যানুলা (সরিষা দানার মতো) থেকে উৎপাদিত অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি হতো কমবেশি সাড়ে ২৬ লাখ টন। বর্তমানে তা কমে ২৩ লাখের ঘরে নেমে এসেছে। মূলত গত তিন বছর ধরে এই চিত্র দেখা যাচ্ছে।

এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে বাংলাদেশ থেকে অনেক কম দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। রাজ্যভেদে ভারতের মুদ্রায় প্রতি কেজি ১২৩ থেকে ১৪৬ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৪০ থেকে ১৬৬ টাকা। কিন্তু দেশের বাজারে বর্তমানে বিক্রি হওয়া দাম এর থেকে অনেক বেশি।

খন্দকার শাহাদাত হোসেন নামে এক ক্রেতা নয়া শতাব্দীকে বলেন, তেল নিয়ে ব্যবসায়ীরা খেলছে। সরকার অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও আসলে সবই শুভঙ্করে ফাঁকি। সরকারের নিয়ন্ত্রণ এখন ব্যবসায়ীদের ‘নিয়ন্ত্রণে’। তাই দাম বাড়ানোর প্রস্তাবেই বেড়ে গেছে। এক দিন আগে তো তেলই পাওয়া যায়নি। আজ তেল পাওয়া গেলেও তা প্রস্তাবিত দাম থেকে অনেক বেশি।

তিনি বলেন, আপনারা লেখেন—আমরা পড়ি কিন্তু সরকারের তো ঘুম ভাঙছে না। ব্যবসায়ীদের ইচ্ছেটাই আসল। সাধারণ জনগণ না খেয়ে থাকলেও সরকারের কিছু আসে যায় না। বাজারের দিকে তাকিয়ে দেখেন সবকিছুর দাম বেশি। এমন কোনো দ্রব্য নেই যেটা সাধারণ মানুষ কিনে খেতে পারবে। নিত্যপণ্য ‘বিলাসী পণ্য’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তেলের খুচরা ব্যবসায়ী জাফর মিয়া বলেন, আমরা বেশি দামে কিনি বলে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। বিক্রি না করলেও জরিমানা করে আর বেশি দামে বিক্রি করলেও জরিমানা দিতে হয়। আমরা এখন মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। আপনারা আছেন মনমতো লিখেন। সয়াবিন থাকলেও নেই পামওয়েল। এ বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, পামওয়েল ছিল। কিন্তু শেষ হয়ে গেছে। এখন তেল বা পামওয়েল আগের মতো পাওয়া যায় না। যতটুকু পাই ততটুকু নিয়ে এসে বিক্রি করি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আগে রমজানে পণ্যের দাম বাড়াত— এখন উল্টো চিত্র। রমজান আসার আগে দাম বৃদ্ধি করে। ফলে রমজানে আর দাম বাড়াতে হয় না। এ কারণে মনিটরিংও আগেভাগেই করতে হবে। কঠোর তদারকির মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

তিনি বলেন, বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের বাড়তি দরে ক্রেতার হাঁসফাঁস অবস্থা। আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। আবার কিছু পণ্যের দর কারসাজিতে বেড়েছে। অনেক পণ্য আছে যা আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মেটাতে হয়। সেসব পণ্যের দামও বেশি। তাই দাম কমাতে আমদানি পণ্যের শুল্ক কমাতে হবে।

বাজারে তেলের ঘাটতি দেখালেও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় পণ্যের মজুদ অনেক। পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। অসাধু ব্যবসায়ীকে সুযোগ নিতে দেয়া হবে না। সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করা হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ভোক্তা অধিদফতর অভিযান চালাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ, সরবরাহ এবং মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলছেন, দুটি কারখানা থেকে সরবরাহ নেই। এদিকে সমন্বয় ছাড়া বিক্রি সম্ভব নয়। আপনি কিনে আনবেন ১০ টাকায়, বিক্রি করবেন ৮ টাকায় তাহলে তো মাল আনবেন না। তেলের দাম বাড়ানো উচিত বলে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার যদি ভ্যাট বাতিল করে তাহলে কিছুটা সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া ভোজ্যতেলের দাম কমানোর বিকল্প পথ নেই।

তেল বিপণনকারী কোম্পানি সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ কুমার সাহা বাজারে তেলের সরবরাহ সংকট আছে জানিয়ে বলেন, বাজারে একটা সংকট তৈরি হয়েছে। তবে আমাদের যা উৎপাদন হচ্ছে পুরোটাই ডেলিভারি হচ্ছে। দাম বাড়ানোই এর সমাধান বলে মনে করি। আমি প্রতিদিন ২ হাজার ২০০ থেকে আড়াই হাজার টন বাজারে ছাড়ছি। আমারটা আমি বলে দিলাম। অন্যেরটা জানি না।

রমজানে ভোজ্যতেলের সংকট হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তেলের দাম ১২ টাকা বৃদ্ধির যে প্রস্তাব সেটা মেনে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মনে হচ্ছে কারণ সবাই তো জানে দাম বাড়বে। দাম বাড়াতে সয়াবিন তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে রিফাইনারি কোম্পানিগুলো। ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতি তেলের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সব রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানের কাছে এ ভোজ্যতেলের আমদানি ও রিফাইনের পরিমাণ জানতে চেয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। গতকাল শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান এ তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, সব রিফাইনারি কোম্পানির কাছে ভোজ্যতেল বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তারা গত তিন মাসে কী পরিমাণ ইম্পোর্ট (আমদানি) করেছে, কত পরিমাণ রিফাইন (পরিশোধন) করেছে, তা কাস্টমস পেপারসহ চাওয়া হয়েছে। এছাড়া তারা কত পরিমাণের ডিও/এসও দিয়েছে, কত ডেলিভারি করেছে এবং কত মজুদ আছে, সেটাও জানতে চেয়েছি।’

সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আগামী সোমবার (৭ মার্চ) পর্যন্ত তাদের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেলে তেল নিয়ে তেলেসমাতি কারা করছে, তা ধরা পড়বে। তথ্য পাওয়ার পর প্রতিটি রিফাইনারিতে ভোক্তা অধিকার অভিযান চালাবে। ভোক্তা অধিদফতর এ কাজে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করছে।’

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ