ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

খেলাপিতে বিপর্যস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান

প্রকাশনার সময়: ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৫১

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণ করেছে ৬৬ হাজার ৭৪০ কোটি টাকার। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকায়, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ১৭ দশমিক ৬২ ভাগ। ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে ৭ হাজার ৬৭০ কোটি টাকার ঋণ, যা মোট খেলাপি ঋণের ৬৫ দশমিক ২৩ শতাংশ।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কাছে আছে মোট খেলাপির ৬৫ ভাগ। প্রতিষ্ঠানগুলোর বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের পর সেই অর্থ তোলা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণ করেছে ৬৬ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকায়, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ১৭ দশমিক ৬২ ভাগ।

এই খেলাপি ঋণের মধ্যে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরই রয়েছে ৭ হাজার ৬৭০ কোটি টাকার ঋণ, যা মোট খেলাপি ঋণের ৬৫ দশমিক ২৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘করোনার বছরে ঋণ পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক ছাড় দিয়েছিল, কিন্তু এসব বিশেষ সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকের মতোই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মোট ঋণের মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করে ঋণ নিয়মিত করার সুবিধা বছরের শেষে ঘোষণা করা হয়েছিল। এ জন্য অনেকে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করেনি। এছাড়া দুর্নীতির কারণে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা নাজুক। টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ফলে গ্রাহকরা আস্থার সংকটে পড়েছেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে বের করে নেয়া হয়েছে প্রচুর অর্থ, যা ফেরত আসেনি। আবার গ্রাহকের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নজরদারির কারণে এ খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নাতি হয়েছে।’

দেশে সক্রিয় ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সাল শেষে এসব প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার ৫৩ কোটি টাকার, যা ওই সময় বিতরণকৃত ঋণের ১৫ দশমিক ০২ শতাংশ। ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিক জানুয়ারি-মার্চে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১০ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা।

তিন মাস পর জুনে এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ২৫ কোটি টাকা কমে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। কিন্তু জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা বেড়ে ১১ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ ৯ মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বেশি খেলাপি, প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতির কারণে খাদের কিনারে অবস্থান করছে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

এগুলো হলো বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেড, ফার্স্ট ফাইন্যান্স এবং প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বিআইএফসি ৮১৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, যার ৯৫ দশমিক ১৮ শতাংশই খেলাপি। টাকার অঙ্কে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৭২ কোটি টাকার ঋণ ফেরত পাওয়ার কোনো আশাই দেখছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ এ ঋণ মন্দ শ্রেণিকৃত।

ফার্স্ট ফাইন্যান্স সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে ১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকার। এর মধ্যে খেলাপি ১ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮৯ দশমিক ৮০ শতাংশ।

এদিকে ফার্স্ট ফাইন্যান্সের মোট ঋণ ৮৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৬৪৭ কোটি টাকা। বিতরণকৃত ঋণের ৭৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ খেলাপি। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ৪২ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি ৩ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। মোট ঋণের ৮১ দশমিক ১৩ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে।

সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিজিংয়ের বিতরণকৃত ১ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা ঋণের ৭৬১ কোটি টাকা খেলাপি, যা মোট ঋণের ৫৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেয়া ৯৬৭ কোটি টাকার ঋণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৭৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪৯ দশমিক ১৯ শতাংশ।

বর্তমানে দেশে চারটি সরকারি ও ৩০টি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঋণের নামে প্রচুর অর্থ বের করার ঘটনা ঘটেছে, যে কারণে এ খাতের আর্থিক ভিত অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগের পর এ খাতের অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে। এর কিছুদিনের মধ্যে আবার এনআরবি গ্লোবাল ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সামনে আসে। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও বিআইএফসিতে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছেন আদালত। অত্যন্ত নাজুক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ তদারকিতে রেখেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ করা আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশেষ করে মন্দ ঋণ এ খাতের পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে। এটি গত এক দশকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। সব মিলিয়ে বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন টাকার সংকটে পড়েছে। ক্রমেই এ খাতের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা কমছে।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ