ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফের টাকার অবনমন

প্রকাশনার সময়: ১০ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৫২ | আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৫৫

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যেত ৬৯ টাকা। মাঝে এক বছর ছাড়া প্রতি বছরই বাংলাদেশি টাকার মান কমেছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করে থাকে ডলারে। অনেকটা ‘রক্ষণশীল নীতি’ অবলম্বন করলেও আওয়ামী লীগ সরকারের ১৩ বছরে সেই ডলারের তুলনায় টাকার মান কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ।

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) এর দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসার পর ব্যাপক আমদানির মধ্যে হঠাৎ করেই ডলারের বিপরীতে মান হারাতে থাকা টাকার মান আবার কমল। মাঝে দেড় মাস অবস্থান ধরে রাখলেও গতকাল রোববার ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমেছে। গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক ডলারের জন্য ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা খরচ করতে হয়েছিল; রোববার লেগেছে ৮৬ টাকা। ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করছে এর চেয়ে চার-পাঁচ টাকা বেশি দরে। খোলা বাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯১ টাকায়। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও জনতা ব্যাংক রোববার ৯০ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯০ টাকা ৩০ পয়সায়। ব্যাংকের বাইরে কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে প্রতি ডলার ৯১ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। ৫ আগস্ট থেকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে। বাড়তে বাড়তে ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায় উঠার পর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ওই একই দর ছিল। রোববার থেকে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। এ হিসাবে দেখা যায়, গত পাঁচ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা ১ টাকা ২০ পয়সা বা ১ দশমিক ৪১ শতাংশ দর হারিয়েছে।

আমদানি বাড়ায় ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় শক্তিশালী হচ্ছে ডলার; বিপরীতে দুর্বল হচ্ছে টাকা। তবে পর্যাপ্ত রিজার্ভ থাকায় এতে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষকরা। মাঝে এক বছর ছাড়া প্রতি বছরই বাংলাদেশি টাকার মান কমেছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করে থাকে ডলারে। অনেকটা ‘রক্ষণশীল নীতি’ অবলম্বন করলেও আওয়ামী লীগ সরকারের ১৩ বছরে সেই ডলারের তুলনায় টাকার মান কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১৩ বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যে পণ্য বা সেবা কিনতে ১০০ টাকা লাগত, বর্তমানে তা কিনতে ১২৫ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এটি সরকারি হিসাবের তথ্য। বেসরকারি হিসাবে এই সময়ে টাকার মূল্যমান আরো বেশি কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রোববার পর্যন্ত মুদ্রা বিনিময় হারের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে এ তথ্য মিলেছে। তথ্যে দেখা যায়, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যেত ৬৯ টাকা। বাংলাদেশে ডলার ও টাকার বিনিময় হার স্বাধীনতার পর থেকে সরকার নির্ধারণ করে দিত। টাকাকে রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা করা হয় ১৯৯৪ সালের ২৪ মার্চ। আর ২০০৩ সালে এই বিনিময়হারকে করা হয় ফ্লোটিং বা ভাসমান। এর পর থেকে আর ঘোষণা দিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না। তবে বিনিময় হার ভাসমান হলেও পুরোপুরি তা বাজারভিত্তিক থাকেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময়ই এতে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রেখে আসছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে অনুসরণ করে আসছে ‘ম্যানেজড ফ্লোটিং রেট’ নীতি। ব্যাংকগুলোর চাহিদা মেটাতে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রোববারও দুই কোটি (২০ মিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এরপরও দর বাড়ছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের রোববার পর্যন্ত (২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে রোববার পর্যন্ত) সবমিলিয়ে ২৫০ কোটি (২.৫ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে যে দরে ডলার বিক্রি করে বা কিনে তাকে আন্তঃব্যাংক লেনদেন ব্যাংক রেট বলে।

ব্যাংকগুলোও একে অন্যের কাছ থেকে এই রেটে ডলার কেনাবেচা করে থাকে। চাহিদা বাড়ার সুযোগ নিয়ে ব্যাংকগুলো এই দরের চেয়ে সাড়ে চার-পাঁচ টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। কিন্তু, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, এই ব্যবধান কখনোই এক থেকে-দেড় টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বাজারে ডলারের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকায় অস্বাভাবিক দাম বাড়ার শঙ্কা নেই। রিজার্ভে পর্যাপ্ত ডলার জমা আছে। প্রয়োজনমতো সেখান থেকে ডলার বাজারে ছাড়া হবে। অথচ বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এরই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, ‘টাকার অবমূল্যায়ন হলে রফতানিকারকরা সুবিধা পান, কিন্তু আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতিতে চাপ পড়ার আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন কৃত্রিমভাবে ডলার কেনাবেচা করে পরিস্থিতি ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা করা।’

‘সমীক্ষায় যদি দেখা যায়, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমলে মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে আর কমতে দেয়া ঠিক হবে না। মহামারির কারণে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর সব দেশেই কিন্তু মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের এখানেও বাড়ছে। এটা যেন বেশি না বাড়ে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।’

অর্থনীতির বিশ্লেষক গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সত্যিই ডলারের বাজারে চরম অস্থিরতা চলছে। এটা কোথায় গিয়ে শেষ হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করেও বাজার স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। আমার মনে হয়, এভাবে হস্তক্ষেপ করে বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না।

‘কেননা, সরবরাহ এবং চাহিদার মধ্যে ব্যাপক তফাত। এখন আমদানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে; ৫০ শতাংশের বেশি। কিন্তু রেমিট্যান্স না বেড়ে উল্টো ২১ শতাংশ কমেছে। রফতানি বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু তা চাহিদার চেয়ে অনেক কম।’

‘এখন কথা হচ্ছে, কতদিন এই অস্থিরতা চলবে। আমদানি আগামী ছয় মাস-এক বছরের মধ্যে কমবে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমারও কোনো লক্ষণ নেই। সে পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের ওপর চাপ আরো বাড়বে। মাস চারেক আগেও রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন ৪৪ বিলিয়ন ডলারের নেমে এসেছে।’

তাহলে সমাধান কী— এ প্রশ্নের উত্তরে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর বলেন, ‘আমি মনে করি, রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলার ছেড়ে হস্তক্ষেপ করে পার্মানেন্ট কোনো সল্যুশন (স্থায়ী সমাধান) হবে না। বাজারকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতটা একটু গুটিয়ে ফেলতে হবে; হস্তক্ষেপ তুলে নিতে হবে। বাজারকে বাজারের মতো চলতে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে যদি ইন্টারব্যাংক রেট ৮৭ টাকা-৮৮ টাকাও হয়, তাও যেতে দিতে হবে। তাহলে, ব্যাংকগুলো ও কার্ব মার্কেটের সঙ্গে ব্যাংক রেটে ডলারের যে পার্থক্য তা কমে আসবে। ধীরে ধীরে বাজার স্থিতিশীল-স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আমি মনে করি, সেটাই হবে একটা স্থায়ী সমাধান।’

আমদানি বাড়ায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন (৪ হাজার ৪০০ কোটি) ডলারের নেমে এসেছে। রোববার দিনের শুরুতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৪ দশমিক ৪৫ বিলিলয়ন ডলার। রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে গত ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছি।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ