ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কিংশুকে অর্থ নাশ!

প্রকাশনার সময়: ০৪ জানুয়ারি ২০২২, ১০:২৮ | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২২, ১৪:৫৭

শুরুটা ছিল সম্ভাবনাময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বন্ধুর সঙ্গে মিরপুর-মণিপুরের আরো চারজন যুক্ত হয়ে ১৯৮৭ সালে গড়ে তোলেন কিংশুক। পরে সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে হয়ে উঠে কিংশুক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড। ২০০ টাকা চাঁদা দিয়ে শুরু হওয়া সমিতিটি একসময় ৩০০ কোটি টাকারও বেশি ফান্ড গড়ে তোলে। অর্জন করে মানুষের আস্থা-বিশ্বাস। সবাক, আবাসন, স্কুল, সিএনজি, ইকো ট্যুরিজম, সিকিউরিটি সার্ভিস, গ্রিন হাউস নার্সারি, সমবায় বাজার, প্রথমা, ইলেক্ট্রো প্রোডাক্ট, চেইন স্টোর, হেলথ ক্লাব, স্টকলট, ইট ভাটা, এগ্রো- একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। বাড়ে ফান্ড। হাজার থেকে লাখ। লাখ থেকে কোটি।

এরপরই শুরু হয় খেলা। প্রতিষ্ঠাতাকে ছিটকে ফেলে স্বার্থান্বেষী একটি চক্র নেমে পড়ে মাঠে। বন্ধ হতে থাকে প্রকল্পগুলো। কর্মকর্তাদের পকেট ভারী হয়। অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতার গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকে সারাদেশে কিংশুকের ২৬টি কেন্দ্রের হাজার হাজার গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা। গ্রাহকের আমানতের বিপরীতে সমিতির দায় বাড়তে থাকে। কিংশুকেরই একটি সূত্রের মতে, এই মুহূর্তে আমানত ও দায়ের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১২০ কোটি টাকারও বেশি। গ্রাহকদের অর্থ পরিশোধের সক্ষমতা কিংশুকের নেই। প্রকল্প বাস্তবায়নে যেসব স্থাবর সম্পত্তি সমিতির নামে ক্রয় করা হয়েছিল সেগুলো হস্তান্তর বা বিক্রি করে ফান্ড সংগ্রহও কিংশুকের পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। গত ২৫ অক্টোবর ২০২১ তারিখে সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এস এ মাহমুদীর করা ৬৫৫২ নম্বর রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট ৬ মাসের জন্য কিংশুকের সম্পত্তি হস্তান্তর বা বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। সমিতির অভ্যন্তরীণ এই পরিস্থিতি বেশিরভাগ গ্রাহকের অজানা। গ্রাহকরা জানতে পারলে কী হবে তা নিয়ে কিংশুকেরই কিছু সদস্য শঙ্কিত।

জানতে চাইলে কিংশুকের বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক নজমুল হুদা বলেন, কিংশুকে সেই অর্থে কোনো সংকট নেই। আমরা গত বছরও একটি খ্যাতনামা অডিট ফার্মকে দিয়ে নিরীক্ষা করিয়েছি এবং সেখানে দেখানো হয়েছে যে কিংশুকের দায়ের চেয়ে সম্পদের পরিমাণ বেশি। এখনও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। গ্রাহকের আমানত নিয়ে কোনো শঙ্কা তৈরি হয়নি।’

তবে এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে কিংশুকের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ৬৭নং সদস্য এস এ মাহমুদী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আমার হাতে গড়া সমিতিটি ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ১৮টি প্রকল্পের মধ্যে বেশিরভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। পারটিসিপেটরী স্কুল, আবাসন, সবাক, নার্সারী ধুঁকে ধুঁকে চললেও মুনাফা করতে পারছে না। সবগুলোই লস প্রজেক্ট। মিরপুর ২, থানার মোড়ে সিএনজি স্টেশনটি শুধু সামান্য লাভে চলমান। অথচ সমিতির রাজস্ব ব্যয় প্রতি মাসে ২ কোটি টাকারও বেশি। একমাত্র সিএনজি স্টেশনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে লস করছে ২ কোটি টাকা। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই বন্ধ করে দিতে হবে সমিতির কার্যক্রম।’

এদিকে, কিংশুক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৭ সদস্য এবং একজন প্রকল্প ইনচার্জের আর্থিক অস্বচ্ছতা, বিভিন্ন অজুহাতে সমিতির ফান্ডের অপব্যবহার নিয়ে তদন্ত করতে সম্প্রতি সমবায় অধিদপ্তর পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত দলটি উক্ত ১৮ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করে মোট ৮টি খাতে মোট ৭৩ কোটি ৭০ লাখ ৯ হাজার ৩৮১ টাকার দায় ধার্য করে দেয়। তবে এই তদন্তের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে কিংশুক কর্তারা উচ্চ আদালতে আপিল করলে সেটির কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে।

কিংশুকের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সমবায় অধিদপ্তরের সমিতি শাখার যুগ্ম নিবন্ধক হাফিজুল হায়দার নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমার জানামতে এখনও কিংশুকের সম্পদের চেয়ে দায়ের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়নি। তবে, সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে গেলে আমাকে একটু সময় দিতে হবে।’

জানা যায়, সাত বন্ধুর ১৪-১৫শ’ টাকার পুঁজি নিয়ে প্রায় ৩৫ বছর আগে গঠিত হয়েছিল কিংশুক। একসময় এই সমিতি মানুষের স্বপ্নের সাথী হয়ে ওঠে। চারিদিকে আলোচনা, পত্র-পত্রিকায় ফিচার, সাক্ষাৎকার, প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক প্রাপ্তি-সাফল্যের বর্ণচ্ছটায় উদ্ভাসিত কিংশুক আজ অন্ধকারের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার প্রতীক্ষায়। গ্রাহকের অর্থনাশের সর্বনাশী প্রক্রিয়া চলমান থাকলে প্রতিষ্ঠানটি কালের গহ্বরে হারিয়ে যেতে বাধ্য- এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন কিছু গ্রাহক। তবে নিজেদের আমানত খোয়া যাওয়ার ভয়ে তারা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ