স্বাধীনতার ৫০ বছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ। অর্থনৈতিক নানা ক্ষেত্রে নারীরা শক্ত ভিত তৈরি করছে। প্রতিযোগিতায় পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নারী।
১৯৭৪ সালের শুমারি থেকে দেখা যায়, সত্তরের দশকের মধ্যভাগে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার ছিল মাত্র ২ দশমিক ৬ ভাগ। আশির দশকেও শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার ছিল মাত্র ৮ ভাগ। তবে নব্বইয়ের দশক থেকে চিত্রটি বদলে যায়। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ দ্রুত বাড়তে শুরু করে। ওই দশকের শেষে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার দাঁড়ায় ২৩ ভাগ।
২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, এটি হয়েছে ৩৬ ভাগ। নারীর কর্মসংস্থানের গুণগত পরিবর্তন হলেও এখনো সিংহভাগ নারী অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার নারী কৃষি, শিল্প ও সেবাসহ নানা খাতে কাজ করছেন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ ভাগ। এর সঙ্গে সংসারের ভেতর ও বাইরের কাজের মূল্য ধরলে তাদের অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ ভাগ।
দেশের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের উৎস পোশাক খাত। মোট গার্মেন্টসকর্মীর প্রায় ৫৪ ভাগই নারী। এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের (এসিডি) জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট ৪২ লাখ ২০ হাজার পোশাক শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২৪ লাখ ৯৮ হাজার। এই খাতে নিয়োজিত নারী কর্মী দেশের শিল্প খাতে নিয়োজিত মোট নারী কর্মীর ৭০ ভাগ।
সব খাতেই সমানতালে কাজ করছেন নারী। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত নারীর সংখ্যা ২১ লাখ ১ হাজার ৮৩০ জন। প্রশাসন ক্যাডারে বর্তমানে ২৬ শতাংশ নারী। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত নারীর সংখ্যা ১৫ হাজার ১৬৩ জন।
২০২০ সালে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের পিএমআইএস তথ্য অনুযায়ী, দেশে পুরুষ নার্সের সংখ্যা মাত্র ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ, ৯০ দশমিক ৬ শতাংশই নারী। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, সেবা খাতে ৭ দশমিক ২ শতাংশ নারী। সেবা খাতে ৩৭ লাখ নারী কর্মরত।
প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে নারীর জন্য ৬০ শতাংশ কোটা থাকলেও সেই সীমারেখা বেশ আগে অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। তবে মাধ্যমিকে শিক্ষক হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ এখনো আশানুরূপ নয়, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় এই হার নগণ্য। চা-বাগানগুলোতে কাজ করা ১ লাখ ২২ হাজারের বেশি শ্রমিকের ৭০ ভাগই নারী।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট কর্মক্ষম নারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কৃষিকাজে নিয়োজিত। নারী শ্রমশক্তির ৭১ দশমিক ৫ ভাগই নিয়োজিত কৃষিকাজে।
‘অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার ১৯৭০-৭১’ প্রতিবেদন অনুসারে, ওই সময় দেশে মোট শিক্ষার্থীর ২৮ দশমিক ৪ ছিল নারী। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১৮৮টি অনুমোদিত ডিগ্রি কলেজে ৯ ভাগের বেশি এবং তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ ভাগের মতো ছাত্রী ছিলেন।
৫০ বছর পর বিবিএসের সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিকে মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর হার প্রায় ৫১ ভাগে উন্নীত হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকেও প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ছাত্রী। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেয়েদের হার কিছুটা কম, ৩৮ ভাগ।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রবাসে কাজ করতে যান মোট ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৬ জন নারী। প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে নারীর হার ১২ দশমিক ৯ ভাগ।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে নারীর ক্ষমতায়ন নিঃসন্দেহে বেড়েছে। বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদে প্রথমবারের মতো একজন নারী স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন। সংসদে নারী আসন ৪৫টি থেকে বাড়িয়ে ৫০-এ উন্নীত করা হয়েছে। তৃণমূলে নারীর ক্ষমতায়নে উপজেলা পর্যায়ে একটি করে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করেছে সরকার। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে নারীদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তিনটি সংরক্ষিত আসন।
বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০১১-১৩ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদে নারী চেয়ারম্যানের হার ছিল শূন্য দশমিক ৬ ভাগ। ২০১৪-২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, উপজেলা পরিষদে নারী ভাইস চেয়ারম্যানের সংখ্যা ৪৮৬ জন। বর্তমানে এ সংখ্যা আরো বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী তার শ্রমের মাধ্যমে উন্নয়নে সহায়তা করছে। তবে শুধু শ্রমবাজার ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণই নয়, প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে উচ্চপদের কাজে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘নারীর বড় পদে না আসার কারণ দক্ষতার অভাব, পারিবারিক কাজের চাপ ও নিয়োগকর্তাদের মানসিকতা। এ জন্য উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো সবচেয়ে জরুরি।’
তিনি আরো বলেন, ‘কর্মস্থলে বাধ্যতামূলকভাবে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ আরো বাড়বে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীবান্ধব নীতিনির্ধারণ ও প্রয়োগ এবং পাশাপাশি পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।’
ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (আইডিএস ইউকে) রিসার্চ ফেলো ড. সোহেলা নাজনীন বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে নারীর ক্ষমতায়নে পরিবর্তন হলেও সেটা একটা পরিসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাধা অনেক ক্ষেত্রে পরিবার থেকে আসে। তবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নারীকে সামনে এগিয়ে নিতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার।’
একজন নারী সামনে এগিয়ে যেতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে পরিবার ও সমাজের সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেন নারী উদ্যোক্তা পিপলস ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার গুডসের স্বত্বাধিকারী রেজবিন হাফিজ।
তিনি বলেন, ‘আগের চেয়ে পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। করোনার মধ্যে অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন। তবে নারীর নিজে কিছু করার ক্ষেত্রে অর্থায়ন সবচেয়ে বড় বাধা। নারীরা ক্ষুদ্র কোনো ব্যবসার জন্যও যেন সহজে অর্থ পেতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি।’
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ