ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

নতুন চ্যালেঞ্জে অর্থনীতি

প্রকাশনার সময়: ১১ নভেম্বর ২০২১, ০৩:১৯ | আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২১, ০৩:২১
সংগৃহীত ছবি

করোনা মহামারির কারণে অর্থনীতিতে চলছে মন্দাভাব। ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠার চেষ্টার সময় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি আরো অনিশ্চয়তায় ফেলেছে অর্থনীতিকে। এই দাম বৃদ্ধিতে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়বে। জীবনযাত্রাকে এটি নানাভাবে প্রভাবিত করে। এরই মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। বেড়েছে পরিবহন ভাড়া। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনীতির বিভিন্ন খাত।

গত ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে এক প্রজ্ঞাপনে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বা ২৩ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। প্রতি লিটার ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম নির্ধারণ করা হয় ৮০ টাকা, যা আগে ছিল ৬৫ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজেল, কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধিতে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, যেহেতু তাদের আয় বাড়েনি। তখন বাধ্য হয়ে তারা ব্যয় সংকোচন করে। ফলে মানুষের ভোগ ব্যয় হ্রাস পায়। সংকুচিত হয় অর্থনীতি। ব্যাহত হয় জিডিপির প্রবৃদ্ধি।

বর্তমানে কৃষি খাতে ডিজেলের ব্যবহার ১৬ শতাংশ। ডিজেলের দাম বাড়ায় সেচের খরচ বাড়বে। এতে করে বাড়বে কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে এর প্রভাব পড়েছে কৃষির ওপর। কারণ কৃষকদের বড় একটা খরচ হয় সেচকাজে। যেখানে ডিজেল ব্যবহার হয়ে থাকে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, প্রথম প্রভাব পড়বে কৃষকের ওপর, দ্বিতীয় পড়বে পণ্য পরিবহনের ওপর। কৃষকের একটা বড় খরচ সেচকাজ। সেখানে ডিজেল ব্যবহার করা হয়। এরপর ট্রাক কিংবা নৌযানের ভাড়া বেড়ে গেলে শাক-সবজি থেকে শুরু করে যে সব পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বাজারে আসে, তার সবেরই দাম বাড়বে। ফলে ভোক্তার ওপর অতিরিক্ত একটা চাপ তৈরি করবে।

বিদ্যুতে ডিজেলের ব্যবহার ২৬ শতাংশ। দেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ডিজেল ও ফার্নেস তেলচালিত। ফলে বিদ্যুতের দাম ও বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে রাজস্ব আহরণে ভাটা পড়বে। কারণ, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে ভোগ ব্যয় হ্রাস পায়। এতে করে অর্থনীতি সংকুচিত হয়। আর অর্থনীতি সংকুচিত হলে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ও আয়কর আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এবার বাজেটে যে পরিমাণ রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, তা পূরণ হবে না। ফলে বাজেট ঘাটতি বাড়বে। ঘাটতি পূরণে সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ বাড়বে। ব্যাহত হবে বেসরকারি খাত।

করোনাকালে দেশের অর্থনীতিতে ঈর্ষণীয় সাফল্য হয়েছে, প্রবৃদ্ধির চাকা অব্যাহত রয়েছে। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়েছে।

ভারতের অর্থনীতির বিপর্যয়ের জন্য করোনা পরিস্থিতি যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী করা হয় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে। ব্যাপক সমালোচনার পর ভারত সরকার তেলের দাম সংশোধন করেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে তেলের দাম না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন জ্বালানির সঙ্গে যুক্ত। এতে পণ্য মূলের ক্রয়ক্ষমতার হিসেবে মানুষের বেতনের অবমূল্যায়ন ঘটবে। অর্থাৎ করোনার পর মানুষের আয় আরেক দফা কমে যাবে। এমনিতেই বেকারত্ব, নতুন দারিদ্র্যে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। নিন্মবিত্ত এবং প্রান্তিক মানুষের ক্ষুধার কষ্টও শুরু হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম আরেক দফা বাড়ানোর ফলে তাদের দুর্ভোগ আরো বেড়ে যাবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক বর্তমানে সরকারি মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, এমনিতেই অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে এই চাপ আরো বাড়বে। তিনি আরো বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে যাচ্ছিল। তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এটি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থনীতির ঝুঁকি এড়াতে এই সময় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্যাবের উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, তেলের দাম বাড়ার ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে। কমবে ভোগ ব্যয়। সংকুচিত হবে অর্থনীতি। এর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, নিত্যপণ্যসহ সব কিছুর দাম যখন আকাশছোঁয়া, তখন কোন যুক্তিতে এ সময়ে তেলের দাম বাড়ানো হলো তা বোধগম্য নয়।

শুধু তাই নয়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ব্যবসার চলমান পুনরুদ্ধারকে আটকে দেবে বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।

সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও সানেমের ড. সেলিম রায়হান বলেন, আমরা জরিপে দেখেছি, করোনার ক্ষতি কাটিয়ে পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছেন বড়- ছোট সব ধরনের ব্যবসায়ী। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে প্রায় সব উৎপাদন শিল্প। তবে সাম্প্রতিক সময়ের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এ প্রবৃদ্ধি আটকে দেবে। তিনি বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে পরিবহন ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং ভোক্তা সবাইকে বিপদে ফেলবে। মানুষ ব্যয় কমিয়ে দেবে। রিকভারি বাধাগ্রস্ত হবে।

সনেমের জরিপ বলছে, সেপ্টেম্বর মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ২১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী পুনরুদ্ধারে (রিকভারি) রয়েছে। ৫২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান রয়েছে মাঝারি মাত্রার রিকভারিতে। অন্যদিকে এখনো দুর্বল রিকভারিতে ২৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। এর তিন মাস আগে ৫ম পর্যায়ের এই জরিপে সানেম জানিয়েছে, জুলাই পর্যন্ত মাত্র ৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী রিকভারিতে পৌঁছাতে পেরেছে। তখন দুর্বল রিকভারিতে ছিল ৬৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। ৫০২টি শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা কিংবা তাদের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গত অক্টোবর মাসে এবারের জরিপটি পরিচালনা করে সানেম।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ