প্রতি মাসেই কমছে রেমিট্যান্স। সদ্য শেষ হওয়া অক্টোবর মাসে গত দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। এ মাসে এসেছে ১৬৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
আর গত বছরের অক্টোবর মাসের চেয়ে কম ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আগের মাস সেপ্টেম্বরের চেয়ে কম এসেছে ৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক কমেছে ২০ শতাংশ।
মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যেও অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪.৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ওই অঙ্ক ছিল আগের বছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বা ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। কিন্তু সেই জোয়ার আর নেই। এখন ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। প্রতি মাসেই কমছে রেমিট্যান্স।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার রেমিট্যান্স প্রবাহের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে ১৬৪ কোটি (১.৬৫ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছরের অক্টোবরে পাঠিয়েছিলেন ২১০ কোটি ২১ লাখ ডলার। আগের মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৭২ কোটি ৬৩ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর রেমিট্যান্স প্রবাহেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ওই বছরের এপ্রিলে মাত্র ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। মে মাসে তা বেড়ে ১৫০ কোটি ৪৬ লাখ ডলারে ওঠে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরোটা সময়জুড়ে (২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন লক্ষ্য করা যায়। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪.৭৮) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশে।
কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটার টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রথম মাস জুলাইয়ে আসে ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগস্টে আসে ১৮১ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে আসে ১৭২ কোটি ৬২ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে প্রথম চার (জুলাই-অক্টোবর) ৭০৫ কোটি ৫০ লাখ (৭.০৫ বিলিয়ন) রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৮৮১ কোটি ৫০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। এ হিসাবে এই চার মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২০ শতাংশ।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আমি আগেই বলেছিলাম রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন বেশি দিন থাকবে না। সেটাই হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, অনন্তকাল ধরে প্রবাসীরা বেশি অর্থ দেশে পাঠাবেন, এটার কোনো কারণ নেই।
তিনি বলেন, কোভিডের কারণে সব কিছু বন্ধ থাকায় এতদিন হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসেনি। সেটাই ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছে। সে কারণে প্রবাহ বেড়েছিল। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় প্রবাসীদের খরচ বেড়েছে। ভ্রমণ-শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে খরচ করছেন তারা। এ কারণেই আগের মতো পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠাতে পারছেন না। আর আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা বেশি দিন ধরে রাখা যায় না।
আহসান মনসুর বলেন, আমাদের একটা বিষয় খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে, প্রবাসী আয় বৃদ্ধির বৈশ্বিক কোনো কারণ নেই, বেড়েছে দেশীয় কারণে। সেটা হলো অবৈধ চ্যানেল (হুন্ডি) বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে সরকার ২ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। এ কারণে যারা আয় পাঠিয়েছিলেন, সবই বৈধ পথে এসেছিল। প্রকৃতপক্ষে করোনায় আয় আসা কিন্তু কমেছিল। কারণ, প্রবাসীদের আয় কমে গিয়েছিল। আহসান মনসুর আরো বলেন, ‘আগে যেমন বছরে ১৬ থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলার আসত, আবার সেই পরিমাণ রেমিট্যান্সেই ফিরে আসবে বাংলাদেশ। এখন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি পাঠানোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, অনেক শ্রমিক চলে এসেছেন। আবার যাওয়াও কমে গেছে। এভাবে চললে প্রবাসী আয় আরও কমে যাবে।’
দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা সোয়া কোটি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ। দেশের জিডিপিতে সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটেও এই প্রণোদনা সরকার অব্যাহত রেখেছে।
রেমিট্যান্স কমায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভেও প্রভাব পড়েছে। সোমবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। আমদানি বাড়ার পরও গত ২৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ১৪৪ কোটি ৮০ লাখ (প্রায় ১.৪৫ বিলিয়ন) ডলার এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) ঋণ রিজার্ভে যোগ হওয়ায় এক লাফে তা বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। আমদানি বাড়ায় রিজার্ভ থেকে প্রয়োজনীয় ডলার চলে যাওয়ায় এক মাসের ব্যবধানে তা আরও কমে প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। রফতানি বাড়ায় গত কয়েক দিনে অবশ্য কিছুটা বেড়ে ৪৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ