ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনামূল্যে ইএফডি আর নয়

প্রকাশনার সময়: ০৭ অক্টোবর ২০২১, ০৪:৩২
ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন

ভ্যাট আদায় বাড়াতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মেশিন বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। দুই বছরেও তাদের নেয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়নি। ২০ লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে মেশিন ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) যন্ত্র বসাতে পেরেছে মাত্র ১৩শ’ প্রতিষ্ঠানে। যার সব খরচ বহন করেছে এনবিআর। পুরোপুরি পূর্বের মতো আর এই মেশিন বসাবে না এনবিআর। ইএফডি এখন থেকে আর বিনামূল্যে পাবে না ব্যবসায়ীরা। ২০ হাজার ৫৩৩ টাকা ব্যয়ে ব্যবসায়ীদের এ যন্ত্র কিনে নিতে হবে। এ টাকা এককালীন বা কিস্তিতে পরিশোধ করা যাবে। গতকাল এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

২০১৯ সালে ভ্যাট আইন চালুর সময় ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিনামূল্যে এক লাখ ইএফডি মেশিন বিতরণের ঘোষণা দিয়েছিল এনবিআর। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুরু থেকেই ইএফডি মেশিন বসানোর কথা ছিল। ২০২০ সালের আগস্টে ইএফডি মেশিন বসানো শুরু হয়। তবে গত কয়েক মাসে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে মাত্র তিন হাজার ৩৯৩টি ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানে এ মেশিন বসানো হয়েছে।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর এক অফিস আদেশে এনবিআর জানায়, ২০ হাজার ৫৩৩ টাকায় ইএফডি মেশিন ও ২৪ হাজার ৫৯৬ টাকায় এসডিসি (সেলস ডাটা কন্ট্রোলার) মেশিন ক্রয় করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। তবে সে ক্ষেত্রে তাদের সংশ্লিষ্ট কমিশনার রেটের রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। ইএফডি/এসডিসি যন্ত্র ব্যবহার না করলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাবে।

ইএফডি হলো আধুনিক হিসাবযন্ত্র। এটি ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রারের (ইসিআর) উন্নত সংস্করণ। যদিও এর আগে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা ইএফডি মেশিন বিক্রিবিরোধী ছিল। পূর্বের ইসিআর মেশিন ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করে না, এমন অজুহাতে ইএফডি মেশিন বিক্রির বিরোধিতা করেছেন তারা।

এনবিআর বলছে, দেশে বর্তমানে আড়াই লাখের বেশি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন আছে। এ যন্ত্র বসানো হলে প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত লেনদেন বা বিক্রির তথ্য জানতে পারবে এনবিআর। এর মধ্যে কত অংশ ভ্যাট তা জানা যাবে। ফলে কর ফাঁকি বন্ধ হবে এবং আদায় বাড়বে।

অথচ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায় বাড়াতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মেশিন বসানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল দুই বছর আগে। ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস বা ইএফডি নামে এই মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে ভ্যাট বিভাগকে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের উদ্যোগ নেয় সরকার। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নানা উদ্যোগ নিলেও দুই বছরে তেমন অগ্রগতি নেই। এখন এসে ইএফডি যন্ত্র ব্যবসায়ীদের কেনার কথা বলছে। এ পরিকল্পনার আওতায় সারাদেশের যোগ্য সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ইএফডির আওতায় আনার কথা বলা হয়। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারাদেশে বর্তমানে ২০ লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। এর ৮০ শতাংশই ছোট ও মাঝারি।

এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, এখন পর্যন্ত মাত্র এক হাজার তিনশ’ প্রতিষ্ঠানে ইএফডি বসানো হয়েছে। এ হিসাবে এক শতাংশের কম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এর বলেন, ‘ভ্যাট বিভাগকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ইএফডি ব্যবস্থা চালু করা হয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। পর্যায়ক্রমে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে এর আওতায় আনা হবে।’

অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের প্রধান উৎস ভ্যাটের বড় একটি খাত হচ্ছে খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসা। কিন্তু এ খাতে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি হয়। মোট ভ্যাট আদায়ের মাত্র তিন শতাংশ এখান থেকে আসে। গত বছরে করা এনবিআরের এক সমীক্ষায় বলা হয়, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা খাতে বছরে যে পরিমাণ লেনদেন হয়, তা মোট দেশজ উপাদন বা জিডিপির ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ এ খাতে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা থেকে নামমাত্র ভ্যাট আহরণ হয়। বর্তমানে বছরে মোট ভ্যাট আদায় হয় ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই হাজার কোটি টাকা আসে খুচরা-পাইকারি খাত থেকে। রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঠিকমতো আদায় করতে পারলে এখান থেকে বছরে বর্তমানের চেয়ে পাঁচ গুণ ভ্যাট আদায় করা সম্ভব।

এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, জিডিপিতে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসার যে অবদান, তার তুলনায় খুব কমই ভ্যাট আহরণ হয়। এ খাতে বেশি নজর দিলে আদায় বর্তমানের চেয়ে বহুগুণ বাড়বে। ইলকেট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার (ইসিআর) চালু করে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় ভ্যাট আদায় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ২০০৯ সালে। কিন্তু ওই ব্যবস্থা নানা ধরনের ত্রুটি ও অনিয়মের কারণে ব্যর্থ হয়।

৯ বছর পর ২০১৮ সালে ইসিআরের উন্নত সংস্করণ ইএফডি চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তখন এক বছেরর মধ্যে সারাদেশে ইএফডি বসানোর কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নেয়া হলেও বাস্তবায়নের চিত্র হতাশাজনক। ২০২০ সালের আগস্টে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে ১০০টি ইএফডি মেশিন চালু করে এনবিআর। করোনার কারণে এর কার্যক্রম পিছিয়ে যায় বলে জানান রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা।

যে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকার বেশি, সে সব প্রতিষ্ঠানে এই মেশিন বসানো হয়। ডিসেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে এক হাজার দুইশ’ মেশিন বসানো হয়।

শুল্কমুক্তভাবে চীন থেকে আমদানি করা প্রতিটি মেশিনের দাম পড়েছে ২২ হাজার টাকা। প্রাথমিকভাবে বিনামূল্যে এসব মেশিন দেয়া হলেও এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, ভবিষ্যতেও বিনামূল্যে দেয়া হবে কিনা, সে বিষয়ে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবে। এসব মেশিন আনার জন্য চীনের ‘এসজেডজেডটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে এরই মধ্যে ঠিকদার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। মেশিন ইনস্টলেশনের বিষয়ে কারিগরি সহায়তাও দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

ইএফডি মেশিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার লক্ষ্যে গত বছর এক আদেশ জারি করে এনবিআর। তাতে হোটেল, রেস্তোরাঁ, মিষ্টির দোকান, পোশাক বিপণি, শপিংমল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, সুপরাশপ, ফার্নিচারের দোকান, জুয়েলারির দোকানসহ ২৫ খাতে এই মেশিন ব্যবহারের কথা বলা হয়।

ইএফডি মেশিন ব্যবহার করে ভ্যাট পরিশোধের জন্য লটারিতে পুরস্কার ঘোষণাসহ এনবিআরের পক্ষ থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলেও কার্যত ফল আসছে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে ইএফডি ছাড়াই ভ্যাট দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রে তদারকি ও সচেতনতার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ শপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হেলালউদ্দিন বলেন, করোনার কারণে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি দোকানদাররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু কর্মকর্তারা এদের কাছ থেকে জোর করে ভ্যাট আদায় করছে। তিনি আরো বলেন, ‘এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। আমরা স্বাগত জানাই। আমরা মেশিনটা কিনে নেব। কোনো সমস্যা নেই, তবে এনবিআর যেন কোনো হয়রানি না করে। ইএফডি মেশিনের রক্ষণাবেক্ষণ ওটা এনবিআরকে করতে হবে।’

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ