ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

নজর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে

প্রকাশনার সময়: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২৬

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার নতুন করে আর একটি টাকাও ঋণ নিচ্ছে না। উল্টো সরকারের আগের নেয়া ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে। এতে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সরকারের ঋণ কমেছে ১৮ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এজেন্ডা নয়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাকে সরকারও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছেপে সরকারকে ঋণ দেয়া থেকে বিরত থাকছে।

নাম প্রকাশ না করে এই কর্মকর্তা আরো উল্লেখ করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মুদ্রা সরবরাহের ক্ষেত্রে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ যাতে খুব বেশি না বাড়ে, সেদিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। তবে বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব এখনো পড়েনি। চাল, সবজি, ডিম, মুরগিসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম আগের চেয়ে বেড়েছে। যদিও পরিবহন খাতে আগের মতো বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য নেই। এমনকি সরকার পতনের পর দেশের মানুষ

আশা করেছিল বাজারে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু না, বাস্তবে তেমন কিছুই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ না নিলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ২৮ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতে দুই মাসে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। গত সরকারের শেষের তিন মাসে নিয়মের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ৪১ হাজার টাকা ছেপে সরকারকে সরবরাহ করেছে। ‘ওভারড্রাফট’ হিসেবে সরকারকে সর্বোচ্চ ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সীমা থাকলেও এক ধরনের ‘জালিয়াতি’র আশ্রয় নিয়ে সরকারকে মোট ৪৮ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে এই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশে ছিল। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে দিয়েছে। এ কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। মূল্যস্ফীতির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, মূল্যস্ফীতি কমে আসছে। আগস্টে তা ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো কমবে। তবে মূল্যস্ফীতি কমার প্রভাব বাজারে পড়তে কিছুটা সময় লাগবে। তিনি মনে করেন, চাঁদাবাজি বন্ধ হলে মূল্যস্ফীতি আরো কমবে। তিনি বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধের বিষয়টি শুধু অর্থনৈতিক নয়, এর সঙ্গে বাণিজ্যও সম্পর্কিত।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আগের দায় পরিশোধ করার এই উদ্যোগ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভালো ফল দেবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাসের শেষে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। গত জুনের শেষে ছিল ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। সরকারের এই ঋণের মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকে গত জুনের তুলনায় ২৮ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা বেড়ে বর্তমানে তিন লাখ ৪৭ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকে গত জুনের এক লাখ ৫৬ হাজার ৪৮ কোটি টাকা থেকে কমে বর্তমানে ঋণ নেমেছে এক লাখ ৩৭ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকায়। মূলত ওভারড্রাফট খাতে দেয়া বাড়তি টাকা সমন্বয় করছে সরকার। গত জুন শেষে এ খাতে যেখানে ৪৮ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ছিল, আগস্টের শেষে তা কমে ২৯ হাজার ৩৫১ কোটি টাকায় নেমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই ও আগস্ট মাসে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয়া ২৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে শুধু আগস্টে নিয়েছে ২৩ হাজার ১০৬ কোটি টাকার ঋণ। আগের মাস জুলাইতে ঋণ নেয়া হয়েছিল ৫ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৫৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে এবার ব্যাংক ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। অবশ্য আগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফার ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়েছে। সরকার এই অর্থ না পেলে ব্যাংক ঋণের চাহিদা আরো বাড়ত। অর্থনীতিবিদরা বরাবরই বলে আসছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার বেশি পরিমাণে ঋণ নিলে বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে তারল্য সংকটে ভুগছে অনেক ব্যাংক। এতে উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অবশ্য ব্যাংকগুলো এখন নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ হিসাবে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড বেছে নিচ্ছে। কারণ সরকার টাকা নিলে সেই টাকা নিরাপদ ও সুদের হারও বেশি। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার আগে বেশি ছিল না। কিন্তু গত দেড়-দুই বছরের মধ্যে সুদের হার সর্বোচ্চ হয়েছে। জানা যায়, গত অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ১২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ঢুকেছে। এসবের প্রভাবে অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে রয়েছে। তবে বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। গত অর্থবছরে সরকার ৯৪ হাজার ২৮২ কোটি টাকার নিট ঋণ নেয়।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ