মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

স্বস্তি মিলছে না চালের বাজারে

প্রকাশনার সময়: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০৫

কুষ্টিয়ার চালের বাজারে এখনো স্বস্তি মেলেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় কেজি প্রতি ২-৫ টাকা বৃদ্ধি পাওয়া দামেই বিক্রি হচ্ছে চাল। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংক লেনদেন স্বাভাবিক না হওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ দেশের কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করায় চালের বাজারে স্বস্তি মিলছে না। উল্টো দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এদিকে নওগাঁয় হাসকিংয়ে কমলেও অটো রাইস মিলে কমেনি চালের দাম। প্রতিনিধি ও সংবাদদাতার পাঠানো খবর—

কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়া শহরের পৌর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম। চালের প্রকারভেদে কেজি প্রতি মিনিকেট ৬৮-৭০, কাজললতা ৬০-৬২, আটাশ ৫৬-৫৮, স্বর্ণা ৪৬-৪৮, বাসমতি ৮৬-৮৮, কালোজিরা ১১৫-১২০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। যা আগের থেকে ২-৫ টাকা বেশি। বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংক লেনদেন স্বাভাবিক না হওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ দেশের কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করায় চালের বাজারে স্বস্তি মিলছে না। উল্টো দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগর। ছোট-বড় মিলিয়ে এখানে প্রায় ৪৫০টি চালকল রয়েছে। যার মধ্যে অটোরাইস মিলের সংখ্যা প্রায় ১০০। বৃহৎ এ মোকামের বেশ কয়েকটি চালের মিল ঘুরে দেখা গেছে, মিল গেটে মিনিকেট চাল কেজি প্রতি ৬৭ টাকা, কাজললতা ৬১ টাকা, বাসমতি ৮৩ টাকা ও আটাশ ৫৬ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চালের মানের ওপর নির্ভর করে দাম ওঠানামা করছে বলে জানান মিলাররা। খুব ভালো মানের চাল একটু বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। আটাশ ধানের সরবরাহ কম থাকায় ও মূল্য বেশি হওয়ায় সব থেকে বেশি দাম বেড়েছে আটাশ চালের। তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের কারণে চালের বাজারে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। দেশের বেশ কয়েকটি জেলা বন্যাকবলিত হওয়ায় ফসলি মাঠ তলিয়ে গেছে। সেজন্য চালের বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়ছে বলেও জানিয়েছেন মিল মালিকরা।

মিলে ধান সরবরাহকারী শাহজাহান মোল্লা জানান, গত ১ আগস্ট মণ প্রতি ১৪০০ টাকা দরে আটাশ ধান কিনেছিলেন তিনি। সেই একই ধান এখন ১৫০০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ১০০ টাকা বেশি দরে ধান কিনতে হলে চালের দাম অবশ্যই বাড়বে।

গোল্ডেন রাইস মিলের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর শিহানুজ্জামান জোহা জানিয়েছেন, ধানের দাম না কমলে চালের দাম কোনোভাবেই কমানো সম্ভব নয়। এজন্য কৃষক পর্যায়ে ধান উৎপাদনের খরচ কমাতে হবে। ধানের বীজ, সার, বিদ্যুৎসহ উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল ক্ষেত্রে খরচ কমাতে পারলে চালের দাম কমিয়ে আনা সম্ভব।

বাংলাদেশ অটো মেজর হাসকিং রাইস মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, দেশের বড় একটি অংশ বন্যাকবলিত হওয়ায় চালের বাজারে বেশ প্রভাব পড়েছে। বন্যার পানিতে ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। এজন্য ফসল উৎপাদন অনেকাংশে কমেছে। তাছাড়া ধানের দাম প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। মিল গেটে জুলাই মাসের চেয়ে চলতি আগস্ট মাসে মোটা চাল কেজি প্রতি ৫ টাকা, মিনিকেট চাল ২ টাকা ও মাঝারি মানের চালের দাম ৩ টাকা বাড়তি বলেও জানান তিনি। তবে চালের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক আছে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি দাবি করেন, এখানকার মিলগুলোর উৎপাদন স্বাভাবিক ছিল। তবে সেসময় পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় বেশ কয়েক দিন মিল মালিকরা কুষ্টিয়া থেকে অন্য জেলায় চাল সরবরাহ করতে পারেননি। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণসহ ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন দেশের শীর্ষ এ চাল ব্যবসায়ী। কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শারমিন আখতার জানান, ব্যবসায়ীরা যাতে সিন্ডিকেট করে চালের দাম ইচ্ছামতো বাড়াতে না পারে সেজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর মনিটরিংসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

নওগাঁ: ধান-চালে সমৃদ্ধ উত্তরের জেলা নওগাঁ। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এ জেলায় প্রতি মণ ধানের দাম কমেছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। যার প্রভাবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মানভেদে প্রতি কেজি চালের দাম ১-২ টাকা কমিয়েছে হাসকিং মিল মালিকরা। স্বাভাবিকভাবে এ সময়ে অটোমেটিক রাইস মিলগুলোতেও চালের দাম কমে আসার কথা। এরপরও চালের দাম কমাতে সময়ক্ষেপণের অভিযোগ উঠেছে জেলার অটোমেটিক রাইস মিল মালিকদের বিরুদ্ধে। অটোমেটিক রাইস মিল মালিকদের দাবি— সম্প্রতি ধানের দাম যতটুকু কমেছে সেই প্রভাব তাদের মিলগেটে পড়তে সময় লাগবে আরো চার-পাঁচ দিন। পূর্বে বেশি দামে কেনা ধান থেকে উৎপাদিত চাল এখনো মিলে রয়ে গেছে। ওইসব চাল বের হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে কম দামে কেনা ধান থেকে উৎপাদিত চাল বাজার মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে বিক্রি করা হবে।

খাদ্য বিভাগের তথ্য মতে, এক দশক আগে হাজারের অধিক চালকল থাকলেও বর্তমানে এ জেলায় সচল চালকল রয়েছে ৩৫৬টি। এর মধ্যে ৪৪টি অটোমেটিক রাইস মিল। বাকি ৩১২টি হাসকিং মিল হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। এসব হাসকিং মিল একত্রে সারা বছরে যে পরিমাণ চাল উৎপাদনে সক্ষম জেলায় বর্তমানে সচল অটোমেটিক রাইস মিলগুলোর চাল উৎপাদনের সক্ষমতা তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।

শহরের সুলতানপুর মহল্লার বিভিন্ন মিলগেট ঘুরে দেখা যায়, ধানের দাম কমে আসায় হাসকিং ও অটোমেটিক রাইস মিলগুলোতে জেলার বিভিন্ন হাট বাজার থেকে কেনা ধানবোঝাই ট্রাক দিনভর প্রবেশ করছে। এসব ট্রাক থেকে ধান নামিয়ে চাতালে শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা। হাসকিং মিলগুলোতে কর্মব্যস্ততা বেড়েছে চাতাল শ্রমিকদের। অটোমেটিক রাইস মিলগুলোতেও পুরোদমে চলছে কাজ। মৌসুমের শেষ মুহূর্তে এসেও যেন এসব মিল হঠাৎই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। পার নওগাঁ মহল্লার আড়তদারপট্টি ঘুরে দেখা যায়, মোকামে বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে মানভেদে প্রতি কেজি জিরাশাইল ৬২-৬৪ টাকা, কাটারিভোগ ৬২-৭০ টাকা, সুভলতা ৫৯-৬১ টাকা এবং স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৫০-৫২ টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে। এর মধ্যে হাসকিং মিলে উৎপাদিত জিরাশাইল, কাটারিভোগ ও সুভলতা জাতের চালের দাম প্রতি কেজিতে কমেছে ১-২ টাকা। চালের বস্তায় জাত, দাম, ওজন ও উৎপাদনের তারিখ উল্লেখ রাখার নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চাল কেনাবেচা করতে দেখা গেছে ব্যবসায়ীদের। দেশমূখ্য ট্রেডার্সের আড়তদার বিশ্বপ্রসাদ দেশমূখ্য বলেন, বর্তমানে হাসকিং মিল থেকে প্রতি কেজি পলিশ বিহীন জিরাশাইল ও কাটারিভোগ চাল ৫৯-৬০ টাকা দরে কেনা হচ্ছে। এসব চাল পলিশ করার পর প্রতি কেজি বিক্রি করা হচ্ছে ৬২ টাকায়। সুভলতা ৫৭ টাকা কেজি দরে কেনার পর পলিশ করে ৫৯ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। হাসকিং মিলে উৎপাদিত এসব চালের দাম প্রতি কেজিতে ১-২ টাকা কমেছে। এরপরও মোকাম ক্রেতাশূন্য। আগে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ ট্রাক চাল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে যেত। এখন দৈনিক ৩০-৪০ ট্রাক চাল বিক্রি হচ্ছে।

সততা রাইস এজেন্সির আড়তদার সুকুমার ব্রহ্ম বলেন, গত বোরো, আউশ ও আমন মৌসুমে ১৭ লাখ টন চাল উৎপাদনে সক্ষম ধান উৎপাদিত হয়েছে নওগাঁয়। আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে চালের চাহিদা রয়েছে মাত্র ছয় লাখ টন। তাই বন্যা পরবর্তী সময়ে অবৈধভাবে মজুদ রেখে কেউ বেশি দামে চাল বিক্রি করার চেষ্টা করছে কি না সে বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে। এখানে কোনো সংকটের সুযোগ নেই। চালের বাজার অস্থিতিশীল হলে তাৎক্ষণিক মজুদবিরোধী আইন অনুযায়ী অবৈধ মজুদকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

মোল্লা অটোমেটিক রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী হাসান মোল্লা বলেন, দেশে চলমান বন্যা পরিস্থিতির কারণে মোকামে চাল কেনাবেচা একেবারেই কমে গেছে। আগের সরকারের আমলে চালের বস্তায় জাত, পরিমাণ, দাম ও উৎপাদনের তারিখ উল্লেখ রাখার বিষয়টি কড়াকড়ি করার প্রক্রিয়া চলছিল। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বে খাদ্য মন্ত্রণালয় থাকায় ওই বিষয় বহাল রাখা বা নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তাই মিলগেট এবং মোকামে যেসব চাল বিক্রি হচ্ছে সেখানে পূর্বের নিয়ম আপাতত মানা হচ্ছে না।

নওগাঁ জেলা অটোমেটিক রাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম বাবু বলেন, অটোমেটিক রাইস মিল সচল রাখতে যে পরিমাণ ধানের প্রয়োজন এখনো সেই পরিমাণে ধান বাজারে সরবরাহ নেই। প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক ধান কিনে মিল সচল রাখতে হচ্ছে। ধানের দাম কিছুটা কমেছে। তবে সহসাই সেই প্রভাব মিলগেটে পড়বে না। মিলগেটে চালের দাম কমতে আরো তিন-চার দিন সময় লাগবে।

তিনি বলেন, এ বছর ধানের পর্যাপ্ত ফলন হয়েছিল। তাই সংকট সৃষ্টির সুযোগ নেই। তবে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কেনাবেচা হুট করে বেড়ে যেতে পারে। কেনাবেচা বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই চালের দাম আগামীতে আরো কিছুটা বাড়বে। তবে সেটা সহনশীল পর্যায়েই থাকবে বলে আশা করছি। উত্তরের জেলাগুলো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত না হলে খাদ্য ঘাটতির কোনো শঙ্কা থাকবে না বলেও জানান তিনি।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ