৪ ঘণ্টার প্রায় ১৮ ঘণ্টাই গ্যাস থাকে না। যতটুকু সময়ের জন্য গ্যাস আসে, তখনো চাপ কম। সেই স্বল্প চাপে কেউ রাত জেগে রান্না করেন, কেউ কেউ বৈদ্যুতিক চুলা ব্যবহার করেন, আবার কেউ দিনের পর দিন হোটেলের খাবারের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এটি রাজধানীর মান্ডা এলাকার চিত্র। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এ এলাকায় গ্যাস না থাকার বিষয়টি দীর্ঘদিনের সমস্যা। কিন্তু যে ছয়-সাত ঘণ্টা এতদিন ধরে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছিল সে সময়ও চাপ কমে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ গ্যাস সংকট সমস্যা রাজধানীর আরও অনেক এলাকায় দেখা যাচ্ছে। যদিও পেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে এ পরিস্থিতি আরও তিন-চার দিন সহ্য করতে হবে। এদিকে, গ্যাসের পাশাপাশি রাজধানীতে দেখা দিয়েছে লোডশেডিং। গত শুক্রবার ছুটির দিনে কোনো কোনো এলাকায় ৭-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে। পিডিবি বলছে, বৃষ্টির কারণে কোথাও কোথাও সমস্যা দেখা দেয়ায় সাময়িক এ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দেশের গ্যাসের চাহিদা ৪১০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছিল ৩২৫ কোটি ঘণফুট। সে হিসাবে প্রতিদিন গ্যাসের ঘাটতি ছিল ৮৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ও এলএনজি সরবরাহ বন্ধ থাকায় এখন দৈনিক গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২৫ কোটি ঘনফুট। ফলে দৈনিক ঘাটতি গিয়ে ঠেকেছে ১৮৫ কোটি ঘনফুটে। যে কারণে রাজধানী ঢাকা ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামে গ্যাস সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে।
রাজধানীর মুগদা ও মান্ডা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুরো এলাকায়ই গ্যাস সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। মান্ডার ছাতা মসজিদ গলির বাসিন্দা খন্দকার আজিজুর রহমান বলেন, ‘এ এলাকার গ্যাস সংকট নতুন কোনো সমস্যা নয়। ১২ মাসই গ্যাস সমস্যা থাকে। তবে গত এক মাস ধরে এ সমস্যা আরও বেড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার চারতলা বাড়ির প্রায় সব ভাড়াটিয়া সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে। কারণ সারা দিন গ্যাস থাকে না। রাত ১২টার দিকে আসে, ফের ভোর ৫টায় চলে চায়। যখন মানুষের ঘুমানোর সময় তখন গ্যাস এলে কী হবে। আর গ্যাস সংকটের কারণে ভাড়াটিয়া পাওয়াও মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ একই গলির রিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘গ্যাস না থাকার কারণে এ এলাকায় ভাড়া কিছুটা কম। সে কারণেই এখানে থাকি। রাতে রান্না করে রাখা হয়, তা দিয়ে পর দিন চলে। তবে দিনে অফিসেই বেশী সময় কেটে যায়। সেজন্য সমস্যা টের পাচ্ছি কম।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই যে রাত ১২টার পর গ্যাস আসত আগে, গত কয়েক দিন ধরে তাও আসে না।
একদম নিভু নিভু করে চুলা জ্বলে।’ এদিকে, গ্যাস সংকটের খবর পাওয়া গেছে— রাজধানীর মৌচাক, মালিবাগ, হাজিপাড়া পেট্রোলপাম্প এলাকা, রামপুরা, বনশ্রী, এদিকে মানিকনগর, গোপীবাগ, টিকাটুলী, তাঁতীবাজার, জনসন রোড, মাতুয়াইল, শনির আখড়া, কেরানীগঞ্জ, আমিনবাজার, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১৪, মাজার রোড, মিরপুর-২, পল্লবী, কালশীসহ আরও অনেক এলাকায়। এসব এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, অন্য দিনগুলোতে গ্যাসের চাপ কম থাকলেও রাতে পাওয়া যেত। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে দিনে তো গ্যাস থাকেই না, আর রাতে চুলা জ্বললেও চাপ কম। অপরদিকে, গ্যাস সংকটের খবর পাওয়া গেছে জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের এলাকা কেরানীগঞ্জ থেকেও।
এসব এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্যাস সংকটের কারণে গ্রাহকরা বোতলজাত গ্যাস এলপিজির দিকে ঝুঁকছে। আর আবাসিকের গ্যাস সংকটের কারণে বিপাকে পড়েছেন হোটেল ও রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরাও। কারণ বেশির ভাগ হোটেল রেস্তোরাঁ লাইনের গ্যাস ব্যবহার করে থাকে। যে কারণে অনেক হোটেল দিনের পর দিন বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
মতিঝিলের হিরাঝিল রেস্তোরাঁর কর্মী সাঈদুর রহমান জানান, ‘লাইনের গ্যাস খুব ঝামেলা করছে। দিনের বেশীর ভাগ সময় গ্যাস থাকে না। যতক্ষণ থাকে তাতেও চাপ কম। বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে হয়েছে। এতে করে খরচ বাড়ছে।’ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন— বিইআরসির সবশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, বর্তমানে ৩৫ কেজি এলপিজির সিলিন্ডারের দাম ৩ হাজার ৯৮৫ টাকা এবং ৪৫ কেজির দাম দাম ৫ হাজার ১২৪ টাকা। গত মাসে বেড়ে এ দাম হয়েছে। গ্রাহকরা বলছেন, একদিকে প্রতি মাসে লাইনের গ্যাসের জন্য টাকা গুনতে হচ্ছে, অন্যদিকে সিলিন্ডারও কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে। এ যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। এ পরিস্থিতি থেকে দ্রুত মুক্তি চান সাধারণ গ্রাহকরা।
গ্যাসের এ সংকট আরও কয়েকদিন থাকবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন- পেট্রোবাংলা। সূত্র বলছে, এ সংকট শুরু হয় ঘূর্ণিঝড় রেমালের পর থেকে। কারণ রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এলএনজির একটি টার্মিনাল দীর্ঘ সময় ধরে অপারেশনে যেতে পারছে না। সেই সঙ্গে পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ওই টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এটি মেরামতের জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হলেও ১৭ জুলাইয়ের আগে ঠিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন এন্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, ‘রেমালে এলএনজি টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গ্যাস সরবরাহ কিছুটা কমে গেছে। সেই সঙ্গে পাইপলাইনেও দুর্ঘটনা ঘটেছে। যে কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কিছুদিন সময় লাগতে পারে।’
এদিকে, গ্যাস সংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে লোডশেডিং। গত শুক্রবার সারা দিন বৃষ্টি থাকায় ঘর থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে নগরবাসীর। বৃষ্টিতে অনেক জায়গায় বিদ্যুতের লাইন পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় লোডশেডিং দেওয়া হয়। রাজধানীর পুরান ঢাকার টিকাটুলী, গোপীবাগ, মানিকনগর, মগবাজার, শান্তিনগর, কাকরাইল, কমলাপুর, পল্টন, যাত্রাবাড়ী, ধোলাইপাড়, মুগদা, মান্ডাসহ অনেক এলাকা থেকে লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে।
গোপীবাগ বিন্দু গলির গ্রাহক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বেলা ১১টার দিকে বিদ্যুৎ চলে গিয়ে বিকাল ৫টার দিকে আসে, আবার রাত ৯টার দিকে গিয়ে রাত ৩টার দিকে আসে।’ একই কথা বলেছেন মানিকনগরের বাসিন্দারা। টিকাটুলীতেও দিনভর বিদ্যুৎ ছিল না।
গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো এলাকায় চার থেকে ৫ ঘণ্টা, আবার কোনো কোনো এলাকায় ২-৩ ঘণ্টা লোডশেডিং ছিল। বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী-ডিপিডিসি ও ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানী-ডেসকো সূত্র বলছে, গত ১১ জুলাই থেকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ কমতে শুরু করে। ডিপিডিসির আওতায় বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি ছিল গড়ে ২০০ মেগাওয়াট। যে কারণে রাজধানীর কোথাও কোথাও লোডশেডিং দিতে হয়েছে।
এদিকে, লোডশেডিংয়ের কথা স্বীকার করে বিদ্যুৎ বিভাগও বলছে, সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হয়েছে। খাতা-কলমে দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার ৭৯৬ মেগাওয়াট। আমদানী করা হয় ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট। শুক্রবার সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের বিপরীতে সন্ধ্যায় সরবরাহ করা হয় ১৩ হাজার ৫৮৭ মেগাওয়াট। যে পরিমাণ সরবরাহ ঘাটতি ছিল তা লোডশেডিং করে কভার করা হয়েছে।
গত শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির এক কর্মকর্তা জানান, ‘আজও (গতকাল) ঘাটতি থাকতে পারে। সেজন্য লোডশেডিং করতে হবে। তবে আগের দিনের তুলনায় কম হতে পারে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস সংকটের প্রভাব পড়েছে বিদ্যুতে। রাজধানী ঢাকায় লোডশেডিংয়ের পরিমাণ কম হলেও গ্রাম-গঞ্জে অনেক বেশী। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় প্রতি দিন কমপক্ষে চার-পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। আর বৃষ্টি হলে লোডশেডিং আরও বাড়ে।
দেখা গেছে, বিদ্যুতের সরবরাহ ঘাটতির প্রভাব পড়েছে শিল্প-কারখানায়। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের শিল্প-কারখানাগুলো প্রতি দিন অপারেশনে যেতে পারছে না। একই অবস্থা বিরাজ করছে ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোয়ও। আর এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ শিগগিরই খুলে যাবে না বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংশ্লিষ্টরা।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ