জুন মাসে কোনো পণ্যের দাম কমেছে বলে মনে হয়নি। উল্টো অধিকাংশ পণ্যের দাম বেড়েছে। কোরবানীর ঈদকে কেন্দ্র করে বাড়ে পণ্যমূল্য— এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিলেন উত্তর বাড্ডার আব্দুল আউয়াল। তিনি জুন মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেয়া ‘জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে’ এ তথ্যকে অবিশ্বাস্য বলছেন। তিনি বলেন, বিবিএস এ তথ্য কোথায় পেল? সবকিছুর দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। জুন মাসে সবচেয়ে বেশী বেড়েছে। অথচ তারা কমছে বলে তথ্য দিচ্ছে, যা অবিশ্বাস্য!
গতকাল রোববার বিবিএস মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। সেখানে গত জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ হয়েছে বলে দাবী করা হয়েছে। এর আগে মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। একই সঙ্গে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও তিন মাস ধরে তা ১০ শতাংশের বেশী আছে। জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ। তবে বিবিএসের এ তথ্য নিয়ে সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে নানা সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষকরা বলেন, মূল্যস্ফীতি এক ধরনের কর; ধনী-গরীবনির্বি শেষে সবার ওপর চাপ সৃষ্টি করে মূল্যস্ফীতি। আয় বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশী হলে গরীব ও মধ্যবিত্ত মানুষ সংসার চালাতে ভোগান্তিতে পড়েন। দুই বছর ধরে চলা এ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। প্রভাব পড়ছে মানুষের যাপিত জীবনে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি বিবিএসের তথ্যের চেয়ে বেশী।
বিবিএসের তথ্যে দেখা গেছে, মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ; আগের মাস এপ্রিলেও তা ছিল দুই অঙ্কের ঘরে, ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭২ শতাংশের মানে হলো, গত বছরের জুন মাসে যেসব পণ্য ও সেবা ১০০ টাকায় কেনা গেছে, চলতি বছরের জুনে সেই একই পণ্য ও সেবা কিনতে একজন ভোক্তাকে ১০৯ টাকা ৭২ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। অর্থাৎ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এই এক বছরে বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের কষ্ট সবচেয়ে বেশী বাড়ে। তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।
জুন মাসে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ হয়েছে। বিবিএসের হিসাব অনুসারে, আগের মাস অর্থাৎ মে মাসে এ মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ।
বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ। খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ।
শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৫৪ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ। খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
মজুরি হার বেড়ে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা মে মাসে ছিল ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। কৃষিতে মজুরি হার হয়েছে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। যা মে মাসে ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। শিল্প খাতে মজুরি বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, যা তার আগের মাসে ছিল ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। সেবা খাতে মজুরি হার বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা মে মাসে ছিল ৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
দুই বছর ধরে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এ পুরো সময় ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশী রয়েছে। মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তাতে লাভ হয়নি। বরং মূল্যস্ফীতি উচ্চ স্তরেই রয়েছে, মাঝেমধ্যে কেবল সামান্য একটু ওঠানামা করছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন দেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
রিজার্ভে টান আর বিশ্ববাজারের অস্থিরতার মধ্যে আইএমএফ এর ঋণের শর্ত মেনে সরকারকে ভর্তুকি তুলে নিয়ে ধাপে ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নীতি সুদহার বাড়ানো এবং সুদের হার বাজারভিত্তিক করার মতো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
এ কঠিন সময়েও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী হাসান মাহমুদ আলী।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে এবং রাজস্বনীতিতেও সহায়ক নীতিকৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে ফ্যামিলি কার্ড, ওএমএস ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারের আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন ছিল। পদক্ষেপ নিতে দেরী করায় এখন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বেগ পেতে হচ্ছে।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ