দেশের হাতেগোনা কয়েকটি প্রাণী খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিজেদের ইচ্ছেমতো প্রাণী খাদ্যের দাম বাড়াচ্ছে। যদিও বাজারে প্রাণিজ আমিষের (গরুর মাংস, মুরগি, ডিম, চাষের মাছ ও দুধ) দাম বাড়লে প্রান্তিক খামারিরা প্রথমেই দায় চাপান প্রাণী খাদ্যের অস্বাভাবিক দামের ওপর। অপরদিকে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক বছরেই দেশে প্রাণী খাদ্যের দাম বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। ছয় বছরের ব্যবধানে যা বেড়েছে ১৩৭ দশমিক ১৯ শতাংশ। এতে পণ্য বিক্রি করে মুনাফা করতে না পেরে প্রান্তিক অনেক খামারি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।
জানা যায়, দেশে বর্তমানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিবন্ধিত ফিডমিলের সংখ্যা ২৯৪টি। এর মধ্যে প্রাণী খাদ্যের বাজার দখল করে রেখেছে মাত্র ডজনখানেক ফিডমিল। এসব কারখানার সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে ছোট ছোট অনেক ফিডমিল। অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রান্তিক খামারিদের এমন অভিযোগ যে ভিত্তিহীন নয় তা বিগত কয়েক বছরের পর্যালোচনায় প্রমাণ মেলে। কয়েক বছর ধরে বিশ্ববাজারে ক্রমান্বয়ে মুরগি, গবাদিপশু ও মৎস্য খাতে খাবার তৈরিতে ব্যবহূত মূল উপাদান ভুট্টা ও সয়ামিলের দাম কমেছে। এমনকি দেশেও এ বছর ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে, দামও কম।
সূত্র মতে, এক কেজি প্রাণী খাদ্যে ভুট্টা ও সয়ামিল থাকে ৯০ শতাংশের বেশি। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ভুট্টার দাম কমেছে কেজিতে ৬-৮ টাকা। প্রতি কেজি ভুট্টা বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ টাকায়। কমেছে আমদানী করা সয়াবিন মিলের (সয়ামিল) দামও। দেশী কয়েকটি কোম্পানিও আগের চেয়ে কম দামে সয়ামিল বিক্রি করছে।
সিন্ডিকেটের কবলে প্রাণী খাদ্য
ফিডের দাম বাড়ার জন্য বরাবরের মতো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেটের দিকেই অভিযোগের তীর ছোট খামারিদের। তাদের দাবি, এসব প্রতিষ্ঠান সময়ে সময়ে নিজেদের মতো করে খাবারের দাম বাড়িয়ে দেয়। এতে বিপদে পড়েন ছোট খামারিরা। সে জন্য দাম নির্ধারণে সরকারের হস্তক্ষেপ চান তারা।
খামারি ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দাম বাড়ার কারসাজিতে তাল দিচ্ছে শক্তিশালী ফিড সিন্ডিকেট। অনেক কোম্পানি থাকলেও পুরো বাজারের ৮০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ কয়েকটি কোম্পানির হাতে। কার্যত সবাই জিম্মি হয়ে পড়েছে তাদের কাছে। তারা মাঝে মধ্যে প্রাণী খাদ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন। এরপর নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়ান। একবার দাম বাড়লে তা আর কমে না। করোনা-পরবর্তী বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ার অজুহাতে ফিডের দাম বাড়ানো হলেও এখনো তা সমন্বয় হয়নি। যদিও বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম অনেক কমেছে। তারা বলছেন, মানবখাদ্যের দাম নির্ধারণ, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণে একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকলেও প্রাণী খাদ্যের দামের সিন্ডিকেটের কলকাঠি দমাতে নেই কেউ। এ কাজ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হলেও প্রতিষ্ঠানটিকে খুব বেশি কার্যকর বলা যাবে না।
ফিডের দাম বাড়ার কারণে দেশে প্রচলিত প্রাণী খাদ্যের উপাদানগুলোর দামও বেড়েছে। গমের ভুষি, ধানের কুঁড়া, মসুরের ভুষি, সরিষার খৈল, ছোলার ভুষি, মুগের ভুষি, খড়, চালের খুদের দামেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব।
জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের খামারি মুমিন হক বলেন, ‘খাবারের দামের কারণে খামার বন্ধ করতে হচ্ছে। কয়েকটি কোম্পানির ফিড শুধু বাজারে মেলে। একটি কোম্পানি প্রথমে দাম বাড়ায়, এর পরপর সব কোম্পানি সেটা অনুসরণ করে দাম বাড়িয়ে দেয়। ২০২০ সালে এক বস্তা ফিডের দাম ছিল এক হাজার ৮৫০ থেকে এক হাজার ৯০০ টাকা। এখন সাড়ে তিন হাজার টাকা। ফিডের এমন দামে আমার মতো অনেক খামারি এখন তল্পিতল্পা গুটিয়েছেন।’
ইন্টিগ্রেটেড ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্ক (আইডিআরএন) বলছে, দেশে প্রাণীর খাবারের দাম গত এক বছরেই বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। কয়েক বছর বিবেচনায় নিলে দেশে এখন প্রাণী খাদ্যের দাম দ্বিগুণ হয়েছে।
গবাদিপশু-মাছের খাবারের দামেও অস্বস্তি
গবাদিপশু ও মৎস্য খাতে খাবারের দাম নিয়েও এমন বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোল্ট্রির মতো এসব ফিডের দামেও অস্বাভাবিক মুনাফা করছে কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ (বিডিএফএ) খামারিদের বিভিন্ন সংগঠন এর আগে ফিডের দাম কমানোর দাবি জানিয়েছে। বিডিএফএ বলছে, ছয় বছরের ব্যবধানে দেশে প্রাণী খাদ্যের প্রধান ছয়টি পণ্যের গড় দাম বেড়েছে ১৩৭ দশমিক ১৯ শতাংশ।
ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় অস্বাভাবিক দাম
বাংলাদেশে প্রাণী খাদ্যের দাম প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অস্বাভাবিক বেশি। পাকিস্তানে লেয়ার মুরগির খাবার প্রতি কেজি প্রকারভেদে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা, ভারতে ৩৬ থেকে ৪৭ টাকা । অথচ বাংলাদেশে সেই মানের খাবার বিক্রি হচ্ছে ৫৭ থেকে ৫৯ টাকায়।
দাম বাড়ার ক্ষেত্রে বারবার অভিযোগের তীর যাচ্ছে সিন্ডিকেটের দিকে। অথচ প্রকৃতপক্ষে দাম কত হওয়া উচিত এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই সরকারি কোনো সংস্থার কাছে। কোম্পানিগুলোর দাবি, ব্রয়লার মুরগির এক কেজি ফিড উৎপাদনে খরচ সাড়ে ৬৩ টাকা। এর মধ্যে শুধু কাঁচামালের খরচ দেখানো হয়েছে কেজিপ্রতি ৫৫ টাকা ৭৩ পয়সা। এরপর প্যাকেজিং, পরিবহন, প্রসেস লস, কোম্পানির মুনাফা ও ডিলার-বিক্রেতাদের কমিশনসহ খামারির কাছে বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৭২ টাকায়।
তবে খরচের এ হিসাবকে শুভঙ্করের ফাঁকি বলছে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)। কিছুদিন আগে এ সংগঠন পোল্ট্রি ফিডের দামের একটি হিসাব জমা দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে। সেখানে তারা ব্রয়লার মুরগির খাবারের প্রতি কেজি কাঁচামালের খরচ সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা বলে দাবি করেছে। এরপর খাবার উৎপাদনে অন্য খরচসহ কোম্পানির মোট খরচ ৫০ টাকা। মুনাফা ও বাজারজাত খরচ মিলিয়ে যৌক্তিক দাম হওয়া উচিত ৬১ টাকা ৭৫ পয়সা।
এসব বিষয়ে বিপিএর সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘পোল্ট্রি ফিডে এমন কোনো গোপন উপাদান নেই, যার খরচ হিসাব করা সম্ভব নয়। আমরা দেখেছি ব্রয়লার মুরগির এক কেজি খাবার বাজারজাত পর্যন্ত খরচ ৬১ টাকা। বাজারে এখন ৫০ কেজির প্রতিবস্তা ফিডের দাম ৩ হাজার ৬০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম পড়ছে ৭২ টাকা। এ হিসাবে প্রতি কেজিতে ১১ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করছে কোম্পানিগুলো।’
তিনি বলেন, ‘লেয়ার ফিডে আরও বেশি মুনাফা করছে কোম্পানিগুলো। এক কেজি লেয়ার ফিডে খরচ ৪৫ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকায়। খামারিদের কাছ থেকে প্রতি কেজিতে বাড়তি ১৩ টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে।’
সুমন হাওলাদার আরও বলেন, ‘কোম্পানিগুলো যে খরচ দেখায় সেটা কাঁচামালের খুচরা বাজারমূল্যের ওপর। কিন্তু কোম্পানিগুলো এক সঙ্গে হাজার হাজার টন কাঁচামাল কিনছে, তাতে খরচ আরও কম হচ্ছে।’
যৌক্তিক দাম নির্ধারণের উদ্যোগ
মুরগি, গবাদিপশু ও মৎস্য ফিডের দাম নিয়ে এমন অসংগতির নানান তথ্য ও অভিযোগ ছিল জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে। শেষ পর্যন্ত এ সংস্থা ফিডের যৌক্তিক দাম নির্ধারণে অনুরোধ জানায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। এরপর মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে নির্দেশনা দেয়। কমিশনের হয়ে এ কাজের দেখভাল করছেন কমিশনের উপ-প্রধান (বাণিজ্য নীতি) মাহমুদুল হাসান। তবে এখনো এ বিষয়ে সমীক্ষা শেষ হয়নি।
মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় এ বিষয়ে কাজ হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। যে কারণে এখন এ বিষয়ে কিছু জানানো যাচ্ছে না।’
তবে এ প্রতিবেদনে যে ফিডের দামে অসংগতি পাওয়া গেছে সে আভাস দিয়েছে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের একটি সূত্র।
সূত্র জানায়, ট্যারিফ কমিশনের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ফিডের দাম অস্বাভাবিক বেশি। দেশী শিল্প সুরক্ষায় সরকার এ খাত শুল্ক রেয়াতি সুবিধা দিয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিক খাতে।
জানা গেছে, প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে, অতিমাত্রায় সুরক্ষার পরেও ফিডের দাম বাড়ছে। মুরগি, গবাদিপশু ও মৎস্য খাতের ৭৫ থেকে ৮৯ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে ফিড কিনতে। অথচ এ জাতীয় ফিড আমদানি করলে দাম অনেক কমবে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ফিডের দামের বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রাণী উৎপাদন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বিভাগীয় প্রধান ড. বিপ্লব কুমার রায় বলেন, ‘আসলে আমাদের ফিডের যৌক্তিক দাম কত সেটা দেখা উচিত। কারণ ফিডের দাম এত হওয়ার কথা নয়।’
ওই বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোছা. পারভীন মোস্তারী প্রাণী উৎপাদনে খরচের বিষয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এক কথায় বলা যায় এ দেশে ফিডের দাম অনেক বেশি। খামারিদের জন্য এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ দেশে ফিডের সিন্ডিকেট রয়েছে। অসাধু চক্র রয়েছে। যে কারণে বাধ্য হয়ে খামারিদের এখন দানাদার খাবারের বিকল্প ঘাস খাওয়ানোর কথা বলছি আমরা। ফিডের দামের কারণে খামারিরা টিকতে পারছেন না। এটা অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।’
পারভীন মোস্তারী বলেন, ‘এখন গবাদিপশু পালনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফিডের দাম। ফিডের দাম বাড়ায় প্রচলিত প্রাণী খাদ্যের দামও বাড়ছে। ফলে অনেক প্রান্তিক খামারি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন।’
কথা বলতে অনীহা ফিডমিল কর্তৃপক্ষের
এসব বিষয়ে কথা বলতে ফিড উৎপাদনকারী কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এ প্রতিবেদক। তবে তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। কেউ কেউ প্রশ্ন শুনে মোবাইল ফোন কেটে দিয়েছেন। কেউবা আবার অন্য অজুহাতে ফোন কেটে দিয়ে পরে আর ফোন ধরেননি।
সবশেষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফিড উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পোল্ট্রি খাবারের বড় উপকরণ ভুট্টা ও সয়ামিল হলেও চালের কুঁড়া, ক্যানুলা মিল, গমের আটা, লবণসহ আরও কিছু উপকরণ আছে। সেগুলোর দাম বেড়েছে। খাবারের মানভেদে উপাদান কম-বেশি হয়। এসব উপকরণের অধিকাংশ আমদানীনির্ভর। এছাড়া ডলারের দাম বেড়েছে। যে কারণে কমনো যাচ্ছে না ফিডের দাম।’
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ