প্রকট আকার ধারণ করেছে তারল্য সংকট। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। কিছু ব্যাংক তাদের গ্রাহকের আমানতের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ১০ লাখ টাকার চেকেও গ্রাহকের কাছে সময় চাইতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সহায়তা নিয়ে দিন পার করছে শরিয়াহভিত্তিক বেশ কয়েকটি ব্যাংক। এর প্রভাব পড়েছে কলমানি মার্কেটেও।
প্রতিনিয়ত উচ্চ সুদে টাকা ধার করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। গত গড়ে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ সুদ হারে ২৪ ঘণ্টার জন্য ৫ হাজার ২৬ কোটি টাকা (ওভারনাইট) ধার দেয়া-নেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ব্যাংকাররা জানান, গত দুই বছর ধরে ব্যাংকিং খাত তারল্য-সংকট নিয়ে চলছে। কোনো কোনো ইসলামী ব্যাংক এক বছরের বেশী সময় ধরে টানা তারল্য-সংকটে ভুগছে। এর প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে। এর প্রভাবে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো চাপে পড়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অর্থবছরের শুরু থেকেই মুদ্রাবাজার থেকে টাকা তুলে নেয়া শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কমে যাওয়া, মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তারল্য সংকট বেড়েই চলেছে।
জানা গেছে, দুর্বল ব্যাংকগুলো সবল ব্যাংকের সঙ্গে বাধ্যতামূলক একীভূত হওয়ার খবরে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে দুর্বল ব্যাংক থেকে আমানত প্রত্যাহার করছেন। শুধু সাধারণ আমানতকারী নন, সরকারী আমানত প্রত্যাহার করার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। অস্বাভাবিক হারে আমানত কমে যাওয়ায় তারা দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে পারছেন না। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করেছে বেসিক ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। এছাড়া কয়েকটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার আমানত উত্তোলন করেছেন গ্রাহকরা। টাকার প্রবাহ কমানোর কথা বলা হলেও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির সময়ে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর ঘটনাও আছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে দেশের ব্যাংক খাতে ছাপানো টাকার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১১ হাজার ৯৪৮ কোটি। এর মধ্যে ছাপানো নোট ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার ১৫৪ কোটি এবং কয়েন ছিল ১ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকার। তবে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সংকোচন করে টাকার প্রবাহ কমিয়ে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫৩৪ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়। অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত এ সংকোচন অব্যাহত থাকে। ওই মাসে টাকার প্রবাহ কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৭ কোটি। কিন্তু পরের মাস নভেম্বরে টাকার প্রবাহ ১ হাজার ৪৭৪ কোটি বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৪ হাজার ৫১১ কোটিতে। আর গত মার্চে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯১ হাজার ১৮৯ কোটি। অর্থাৎ সংকোচন থেকে বেরিয়ে ৫ মাসেই বাজারে ১৮ হাজার ১৫২ কোটি টাকা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও জুন পর্যন্ত তা কয়েকগুণ বেড়েছে বলে জানা গেছে। দেশে বর্তমানে মানি মাল্টিপ্লেয়ার ৫-এর বেশী। সে হিসাবে অর্থনীতিতে ৯০ হাজার কোটি টাকার প্রভাব তৈরী করতে পারে। এটি দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, একদিকে বলছে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, আবার অপরদিকে ব্যাংকগুলোকে রেপো সুবিধা দেয়া হচ্ছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে রেপোতে ধার দেয়া সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
এ কারণেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো প্রভাব পড়ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের শুরু থেকেই ব্যাংকগুলোর আন্তঃব্যাংক কলমানিতে সুদের হার দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশের বেশী। এটি গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ গড় সুদহার। আর কলমানিতে ২০ জুন ৫ দিনের জন্য ধার নেয়ার বিপরীতে সর্বোচ্চ সুদহার দাঁড়িয়েছে ১১.৫০ শতাংশ। এদিন কলমানি ৯১ দিনের টার্ম লোনে সর্বোচ্চ সুদহার উঠেছে ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ। চলতি মাসের প্রথম ১০ কর্মদিবসেই শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশী। এদিকে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন করে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো, অ্যাসিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট ফ্যাসিলিটি (এএলএসএফ) ও ইসলামিক ব্যাংকস লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটি (আইবিএলএফ) সুবিধার আওতায় ৮ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা ধার নিয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। এর আগে গত ১৯ মে নিলামে ৪২টি ব্যাংক ও ৪টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) রেপো ও তারল্য সহায়তা সুবিধার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ১৭ হাজার ৯২ কোটি ৪ লাখ টাকা ধার নিয়েছে।
অর্থাৎ বেশীর ভাগ ব্যাংক ঋণ নিয়ে আগের ঋণ পরিশোধ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও কলমানি মিলে গড়ে প্রতিদিন ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা ধার নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে সরকারী, বেসরকারী উভয় খাতেরই ব্যাংক রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, তারল্য সংকটে পড়ে চলতি জুনের প্রথম ১০ কর্মদিবসে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৫২ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। এর মধ্যে গত ৯ জুন সর্বোচ্চ ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করেছে ব্যাংকগুলো। এসব ধারে সর্বোচ্চ সুদ হার ছিল ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর সর্বনিম্ন সুদ গুনতে হয়েছে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নেয়া ঋণ বা ধারের পরিমাণ গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার ৬৪৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে এসে ধারের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭৭১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। সে হিসাবে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর ধার বেড়েছে ৬ হাজার ১১২ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে টাকা তুলে নিচ্ছি। এ কারণে ব্যাংকগুলোতে কিছুটা তারল্যের সংকট দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়েছে। এতে সব ধরনের সুদের হার বেড়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক আরও কিছু টুলস ব্যবহার করে বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে।
তিনি বলেন, সংকট যাতে প্রকট আকার ধারণ না করে, সে জন্য আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো, অ্যাসিউরড লিক্যুইডিটি সাপোর্ট ফ্যাসিলিটি (এএলএসএফ), স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) এবং শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর জন্য স্পেশাল লিক্যুইডিটি সাপোর্টসহ (এসএলএস) বিভিন্ন মাধ্যমে সহায়তা দিচ্ছি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলে এবং সংকোচন থেকে বেরিয়ে গেলেই ব্যাংকের তারল্য সংকট কেটে যাবে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ