ডলার সংকট ঠেকাতে দুই বছর আগে থেকে ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটে সরকার। এ জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কমানো হয়েছে আমদানী। বিলাসী পণ্য আমদানীতে আরোপ করা হয় কড়াকড়ি। কিন্তু এতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এরপরও বেড়েছে সংকট। যা এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর ধারাবাহিতকায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেও কমেছে ডলার প্রবাহ।
দায় ও ঋণ পরিশোধের জন্য দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের বিদেশী হিসাবে (নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট) ডলার জমা রাখে। চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে টানা চার মাস ব্যাংকগুলোতে ডলারের স্থিতি কমেছে। বিশেষ করে গত সাত মাসে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর রিজার্ভ কমেছে ১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর দায় পরিশোধের তুলনায় ডলার প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণেই মূলত এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত এপ্রিল শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা ডলারের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫০৪ কোটি ৭৩ লাখ, মার্চে ছিল ৫৪৩ কোটি ৯৩ লাখ। এক মাসে কমেছে ৪৫ কোটি ডলার। গত বছরের এপ্রিলে ছিল ৫৪৯ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ডলার স্থিতি ছিল ৫৯০ কোটি ৫ লাখ। এর পরের মাস আগস্টে তা কিছুটা কমে ৫৮০ কোটি ৮৭ লাখ ডলারে দাঁড়ায়।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলোর কাছে সবচেয়ে বেশী ৬১৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার ছিল। এরপর থেকে তা ক্রমেই কমতে থাকে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে ৫৯২ কোটি ৪০ লাখ, নভেম্বরে ৫৯৭ কোটি ৯ লাখ, ডিসেম্বরে ৫৫৫ কোটি ৯৭ লাখ, জানুয়ারিতে ৫৮৪ কোটি ৪২ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ৫৫৩ কোটি ৪৫ লাখ ও মার্চে ৫৪৩ কোটি ৯৩ লাখ ডলার ছিল দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে।
সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক নীতির কারণে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ কিছুটা কমে এসেছে। জুলাই-মার্চ সময়ে ৪৫ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। যা আগের বছর ছিল ৪৯ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। দেশের একাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের ঘাটতি চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল মাত্র ২ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। সরকার বর্তমানে বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নেয়ার চেয়ে পরিশোধ করছে বেশী। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে নিট বিদেশী ঋণ ছিল ঋণাত্মক ১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ঋণাত্মক ১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার।
এ বিষয়ে পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমদানী নিয়ন্ত্রণ করা সত্ত্বেও দায় মেটাতে ব্যাংকগুলোকে কিছু ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। অন্যদিকে রপ্তানী আয় ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ডলার আসছে না। এ কারণেই ব্যাংকগুলোর আমদানী ব্যয় পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে।
সম্প্রতি ডলারের সরবরাহ বাড়াতে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এতে উৎসাহ দিচ্ছে। প্রবাসীদের কাছ থেকে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ উৎসাহিত করতে বর্তমানে দেশের ২৫টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে ডলার সংকটে কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। গত সপ্তাহে সামান্য বাড়লেও গ্রস রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ও ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখনো ১৩ বিলিয়নের ঘরেই অবস্থান করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২১ মে পর্যন্ত গ্রস রিজার্ভ ২৪ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভ ১৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার আর বিপিএম-৬ অনুযায়ী ছিল ২৩ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। তবে বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব আছে, যা শুধু আইএমএফকে (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) দেয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ওই বছর ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এরপর তা বেড়ে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশের রিজার্ভ রেকর্ড গড়ে ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট। ওইদিন রিজার্ভ ৪৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ৮০৪ কোটি ডলারে উঠে যায়। এরপর ডলার সংকটে গত বছর থেকে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ২৫ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫-১৬ তে ৩০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৩২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৩৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন। ২০২০-২১ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার এবং সব শেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৩১ বিলিয়ন ডলার।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ