চার বছর বিরতির পর সাধারণ ক্ষমার আওতায় আগামী অর্থবছরে ফেরত আসতে পারে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ। এ বিষয়ে অবহিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে যে কেউ কালো টাকা টাকা সাদা করার সুযোগ পাবে— আসন্ন বাজেটে এমন বিধান যুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার। একটি অ্যামনেস্টি বা সাধারণ ক্ষমাসহ এ সুযোগ দেয়ার ফলে অর্থের উৎস সম্পর্কে সরকারের কোনো সংস্থা প্রশ্নও করবে না।
এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার মাত্র ১০ শতাংশ কর পরিশোধ করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সূত্রগুলো জানায়, ওই অর্থবছরে প্রায় ১১ হাজার ৮৩৯ জন ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বৈধ করে যা ছিল দেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ কালো টাকা সাদা করার ঘটনা। এসব বিনিয়োগ থেকে ২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছিল এনবিআর। এর মধ্যে ৭ হাজার ৫৫ জন এনবিআরের অস্থায়ী বিধানের আওতায় ব্যাংকে জমা বা নগদ ১৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা বৈধ করেছেন। বাকি টাকা জমি, ফ্ল্যাট বা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যক্তি করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ, যা আগামী অর্থবছরে ৩০ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে এনবিআর। আর যদি সরকার সুযোগ দেয়, তাহলে মাত্র অর্ধেক কর দিয়ে অঘোষিত টাকা সাদা করার সুযোগ পেতে পারেন এ অর্থের মালিকরা।
বর্তমান আয়কর আইন অনুযায়ী, যে কোনো করদাতা সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ কর দিয়ে এর সঙ্গে ওই করের ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পান। তবে এর বাইরে প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে এলাকাভেদে নির্দিষ্ট আয়তনের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত কর পরিশোধ করেও টাকা সাদা করার সুযোগ আছে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট যে কোনো সংস্থা চাইলে পরে ওই টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারবে। অবশ্য তাতে খুব একটা অর্থ সাদা হচ্ছে না বা মূলধারার অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছে না। অর্থনৈতিক অঞ্চল বা হাইটেক পার্কে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এ বিনিয়োগে অ্যামনেস্টি পান বিনিয়োগকারীরা। ২০২১-২২ অর্থবছরে মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশ থেকে অঘোষিত অর্থ দেশে আনার সুযোগও দেয়া হয়। সরকারের এ ধরনের উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এমন সুযোগ দেয়া উচিত হবে না। আমাদের মতো করদাতাদের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ হারে কর দিতে হচ্ছে। যারা কর ফাঁকি দিল, কিংবা চুরি করা অর্থ নিয়ে আসবে, তাদের যদি মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়, তাহলে সেটা আমাদের মতো করদাতাদের ওপর অন্যায্য সিদ্ধান্ত হবে। এমন সিদ্ধান্ত মানুষকে কর প্রদানে নিরুৎসাহিত করে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘হয়তো এমন কথা ছড়ানো হচ্ছে যে, এ সিদ্ধান্ত নিলে বিদেশ থেকে টাকা আসবে।’ বাংলাদেশের সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও কালো টাকা সাদা করার বিপক্ষে বরাবরই বলা হয়ে আসছে। সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে সাদা করা হয় প্রায় ৯ হাজার ৬৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। তখনো পর্যন্ত এটাই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ কালো টাকা সাদা করার ঘটনা। ২০২০-২১ অর্থবছরে পুঁজিবাজার, আবাসন, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র ও নগদে টাকা জমার প্রায় সব খাতে বিনিয়োগে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়। প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে এলাকাভেদে নির্দিষ্ট আয়তনের ওপর ভিত্তি করে করের হার নির্ধারণ করে জমি ও ফ্ল্যাট ক্রয়ে অপ্রকাশিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়। তবে এ সুযোগ সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানো হয়েছে জমাকৃত অর্থের ক্ষেত্রে।
চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ ওই সময়ে তাদের কালো টাকা সাদা করেছেন। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের প্রায় সবকটি সরকারই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে সাড়া না পাওয়ায় এসব উদ্যোগের বেশির ভাগই ব্যর্থ হয়েছে। কারণ সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে এসব অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রাখা হয়েছিল। কালো টাকা সাদা করার সময় বা এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর কেউ যেন অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন না তুলতে পারে, এজন্য ২০২০ সালে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করে এনবিআর।
রাজস্ব বোর্ডের সূত্রগুলো জানায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪৫০ কোটি টাকার অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করা হয়, কিন্তু এর পরের আর কোনো তথ্য নেই। তবে এনবিআর জানায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ৯ হাজার ৬৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বৈধ করা হয়। আর ১৯৭২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৩ হাজার ৩৭২ কোটি কালো টাকা সাদা করা হয়েছে। এ থেকে সরকারের মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বড় পরিসরে এবং কম করহারের সুযোগ দেয়ায় কালো টাকার মালিকদের উৎসাহিত করা হয়েছে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ