ঢাকা, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অস্থির মসলার বাজার

প্রকাশনার সময়: ২৩ মে ২০২৪, ০৭:৪০

দেশের বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে মসলার বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে একের পর এক বেড়েই চলেছে জিরা, এলাচ, গোলমরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গসহ প্রায় সব মসলার দাম। ব্যবসায়ীদের দাবি, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ ঘাটতির কারণেই মসলার দাম বাড়ছে। তবে পুরো মসলার বাজারই এখন সিন্ডিকেটের কবলে। এরাই গত এক সপ্তাহে জিরা, এলাচ ও লবঙ্গের মতো মসলার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ এসব মসলা আমদানি হয়েছে তিন থেকে চার মাস আগে। দীর্ঘদিন ধরেই চাল-ডাল-আটাসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সে তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে এলাচ দানা, জিরা, লবঙ্গ, মরিচ, হলুদ, ধনিয়াসহ বিভিন্ন প্রকারের মসলা। এদিকে মসলার বাজার অস্থির করার বিষয়টি তদারকি করতে শিগগিরই অভিযান পরিচালনার কথা বলেছে প্রশাসন।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার সংকট ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে এখন মসলার দাম অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। মসলা জাতীয় পণ্যের দাম দুই কারণে বাড়ছে। প্রথমত, দেশে এখন চলছে ডলার সংকট। ডলারের অভাবে এলসি করা যাচ্ছে না। একইভাবে বেড়েছে ডলারের দামও। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারে মসলার দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশের বাজারেও। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এলাচের দাম।

শনিবার (২২ মে) খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে বড় দানার ভালো মানের প্রতি কেজি এলাচ চার হাজার থেকে চার হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে এই এলাচের কেজি বিক্রি হয়েছে তিন হাজার ৮০০ টাকায়। ছোট দানার প্রতি কেজি এলাচ বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ৮০০ টাকায়। গত সপ্তাহে একই মানের এলাচ তিন হাজার ৫৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত সপ্তাহে লবঙ্গের দাম ছিল এক হাজার ২০০ টাকা। এখন একই লবঙ্গ বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৪০০ টাকায়। গত সপ্তাহে প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হয়েছে মানভেদে ৫৫৭ টাকায়, যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়। গত সপ্তাহে যে গোলমরিচ প্রতি কেজি ৭৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, এখন তা ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি দারুচিনি ৪০০ টাকা, হলুদ ৩১০ টাকা, কালিজিরা ৩২০ টাকা, কিশমিশ ৮০০ টাকা, তেজপাতা ১২০ টাকা আর সাদা সরিষা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। কেজিতে ৫০ থেকে ৮০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি জয়ত্রী বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার টাকায়।

ভারতের রপ্তানির ঘোষণার পরও চট্টগ্রামের বাজারে কোথাও পণ্যের দাম কমার লক্ষণ নেই। বরং প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে। পাইকারি বাজারে ভালো মানের ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৫ টাকায়। আর খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। যা আগে ছিল ৭০ টাকার নিচে। পাইকারি বাজারে দেশীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকার বেশি দামে। খুচরা বাজারে দেশীয় পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৭৫ টাকার বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে মানভেদে পাঁচ টাকা কম-বেশি। অথচ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য বলছে, বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পর্যাপ্ত মসলা জাতীয় পণ্য আমদানি হয়েছে। সুতরাং সরবরাহ ঘাটতির কোনো কারণ নেই। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নেতারা বলছেন, কোরবানির বাড়তি চাহিদাকে কেন্দ্র করে কয়েকগুণ বেশি মুনাফা করতেই অসাধু ব্যবসায়ীরা মসলার দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২৪ হাজার ২৬৭ টন এলাচ, ৪১ হাজার ৩৪৬ টন জিরা, ৩২ হাজার ১৭০ টন লবঙ্গ এবং ২৯ হাজার ৬৪৬ টন গোল মরিচ আমদানি হয়েছে। এটি গত বছরের এ সময়ে আমদানির তুলনায় অনেক বেশি। কাস্টমসের কর্মকর্তারা জানান, পর্যাপ্ত পরিমাণে মসলা জাতীয় পণ্য আমদানি করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব কাস্টমস থেকে পণ্য খালাস করা হচ্ছে। যাতে বাজারে কোনো ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয়। মূলত ভারত থেকে জিরা ও এলাচ, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম ও গুয়েতেমালা থেকে দেশে লবঙ্গ ও দারুচিনি আমদানি করা হয়। এতদিন এসব দেশে উৎপাদন কম হওয়ার অজুহাত দেখালেও এখন এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি।

বাড়তি দাম নিয়ে বাংলাদেশ মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি অমর কান্তি দাশ নয়া শতাব্দীকে বলেন, মসলার বড় একটি অংশ আসে ভারত থেকে। বর্তমানে সেখানে জিরা, এলাচসহ কয়েকটি মসলা পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তাছাড়া ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের তুলনায় আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দামের ওপর।

অন্যদিকে খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ী কামরুল হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু কিছু মসলার দাম বেড়েছে। মসলাকে বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই এ পণ্য আমদানিতে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি শুল্ক দিতে হয়। পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়ায় মসলার বাজার চড়া। এ কারণে এলাচসহ সব ধরনের মসলার দাম বেড়েছে।

তবে ব্যবসায়ীদের এ দাবি মানতে নারাজ ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা সব সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এখনো কোরবানির ঈদ আসতে প্রায় এক মাস বাকি। এরই মধ্যে তারা মসলার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। দাম বাড়ার জন্য তারা ডলারের দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ ঘাটতির কথা বলছে। এগুলো অযৌক্তিক কথা। কারণ বর্তমানে যেসব মসলা বাজারে আছে, তা কয়েক মাস আগে আমদানি করা। সেসব মসলা তো বর্তমান বাড়তি দামের ডলারে কেনা নয়। তাই ডলারের দামের প্রভাব এসব পণ্যের ওপর এখনই পড়ার কথা নয়। এগুলো তাদের অজুহাত ছাড়া আর কিছু নয়। প্রশাসনের কঠোরতার অভাব ও নিয়মিত বাজার তদারকি না থাকার কারণেই ভোক্তাকে বাড়তি দামে মসলা কিনতে হচ্ছে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, প্রতি বছর কোরবানি ঈদকে টার্গেট করে অসাধু ব্যবসায়ীরা মসলা পণ্যের দাম ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দেয়। এবারও একই পথে হাঁটছে তারা। এরই মধ্যে কারসাজি করে কেনা দামের তুলনায় কয়েকগুণ বাড়তি দামে এলাচ বিক্রির প্রমাণ পেয়েছি আমরা। বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করে জরিমানাও করা হয়েছে। মসলার বাজার নিয়ে কারসাজিতে কারা জড়িত, সেটি চিহ্নিত করতে বড় পরিসরে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে।

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ