জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আগামী অর্থবছরে ৩০০টিরও বেশি পণ্যের আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমানোর পরিকল্পনা করেছে। এলডিসি-পরবর্তী বৈশ্বিক বাণিজ্যর জন্য প্রস্তুত হতে শুল্ক (ট্যারিফ) যৌক্তিকীকরণ পদক্ষেপের অংশ হিসাবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ পরিমাণ শুল্ক দেশের মোট ট্যারিফ লাইনের প্রায় ১০ শতাংশ। তবে শুল্ক কমানোর জন্য বিবেচিত পণ্যগুলোর আমদানিমূল্য ১০০ কোটি টাকারও কম বলে জানিয়েছেন এনবিআর। যেখানে গত অর্থবছরের মোট বার্ষিক আমদানি ছিল ছয় লাখ কোটি টাকারও বেশি। এসব পণ্যে শুল্ক কমানো হলে তার রাজস্ব প্রভাব আমদানি করের শূন্য দশমিক শূন্য ২ শতাংশেরও কম হবে বলে জানায় এনবিআর।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত তালিকায় গবাদি পশুর মাংস ও অন্যান্য অংশ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় ও অন্যান্য ধরনের স্যামন ও টুনা মাছ, মাথা, লেজ, পাকস্থলী এবং অন্যান্য অংশ, ড্রাইফিশ এবং কিছু শাকসবজি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
চলতি অর্থবছরেও প্রায় ৩০০ পণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। তালিকাভুক্ত পণ্যগুলো মোট আমদানির ‘অতি নগণ্য’ অংশ হওয়ায় এবং সর্বাধিক ভোগকৃত খাদ্যপণ্য এ তালিকায় না থাকায় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, এ পদক্ষেপের সুবিধা ভোক্তারা খুব বেশি নাও পেতে পারেন। বিশ্বের বিভিন্ন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ এবং স্বল্পোন্নত দেশ উভয়ের তুলনায় বাংলাদেশের গড় আমদানি শুল্ক অনেক বেশি হওয়ায় দেশের ভোক্তাদেরকে ভোগ্যপণ্যের বৈশ্বিক মূল্যের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ করতে হয় উল্লেখ করে তারা আমদানি পর্যায়ে বড় অঙ্কে শুল্ক কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। এনবিআরের এ উদ্যোগ দেশের এলডিসি-পরবর্তী রপ্তানি প্রস্তুতির জন্যও সামান্যই সহায়ক হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাউন্ড রেট অনুসারে শুল্ক কমাতে হবে এবং রপ্তানি খাতগুলোকে ২০২৬ সালের পরে উৎকর্ষের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। ওই বছর এলডিসি-উত্তরণের পর দেশের রপ্তানিকারকরা অনেক বাণিজ্য ও শুল্ক সুবিধা হারাবেন। বর্তমানে বাংলাদেশের ট্যারিফ লাইনে প্রায় সাড়ে চার হাজার পণ্য রয়েছে। এসব পণ্যে সম্পূরক শুল্ক ১০ থেকে ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে। এনবিআরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তালিকাটি প্রথমে অর্থমন্ত্রী ও পরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। সরকার আগামী ৬ জুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ঘোষণা করতে পারে। রাজস্ব কর্মকর্তারা বলছেন, রাজস্ব বোর্ড এলডিসি থেকে স্নাতক হওয়ার পর রপ্তানির প্রতিযোগিতাসক্ষমতা তৈরির অংশ হিসাবে এ পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করছে। আমাদের চার হাজারের বেশি ট্যারিফ লাইনের মধ্যে আগামী দু’বছরের মধ্যে প্রায় এক হাজার ট্যারিফ লাইনে আমদানি শুল্ক কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। যদি আমরা আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এ বছরের জন্য প্রস্তাবিত তালিকা ছোট করতে পারি, তাহলে এ সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৬০০-এ। ২০২৬ সাল নাগাদ আমরা আরও ৪০০ ট্যারিফ লাইন কমানোর লক্ষ্য নিয়েছি। যদিও এ তালিকায় থাকা পণ্যগুলো খুব বেশি আমদানি করা হয় না বা এতে কোনো উল্লেখযোগ্য রাজস্ব ক্ষতি হবে না, তবে আমাদের ২০২৬ সাল ও তার পরবর্তীসময় থেকে বেশি আমদানি হওয়া এবং রাজস্বে প্রভাব রাখা পণ্যের ওপর শুল্ক হ্রাস করার লক্ষ্য রয়েছে।
শুল্ক কর্তন ‘ধারণাগত’: পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)-এর চেয়ারম্যান জায়েদী সাত্তার তার প্রতিষ্ঠানের একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের গড় আমদানি শুল্ক ১৪ শতাংশ এবং নমিনাল প্রটেকশন রেট ২৭ শতাংশের বেশি। যেখানে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে গড় নমিনাল প্রটেকশন রেট মাত্র ৭ শতাংশ। এ গড় স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ১১ শতাংশ এবং বৈশ্বিক হিসেবে ৬ শতাংশ।
পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রাজস্ব বোর্ড হয়তো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে চাইবে যে, আমরা অনেক পণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়েছি। তবে এটা ভোক্তাদের ওপর কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে না। এ পদক্ষেপ ধারণাগত হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্থানীয় শিল্পকে এত শুল্ক সুরক্ষা দেয়া যায় না। হয় ট্যারিফ কমানো উচিত অথবা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত একই পণ্যের ওপর সমান শুল্ক হার আরোপ করা উচিত।’
দামের ধাক্কা থেকে নেই রেহাই : বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দিয়েছেন, যদি রাজস্ব বোর্ডের আমদানি শুল্কনীতির ফলে ভোক্তাদের জন্য দাম না কমে, তাহলে কেবল বিপুল সংখ্যক পণ্যের ওপর শুল্ক হ্রাস করে কোনো বাস্তব উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। কোনো অর্থপূর্ণ প্রভাব ছাড়া এটা নিছক লোকদেখানো হবে বলে মনে করেন তারা। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ‘যদি এনবিআর-এর সিদ্ধান্ত ভোক্তার পকেটে কোনো ইতিবাচক প্রভাব না রাখে, তাহলে তা নিরর্থক।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুখাদ্য পরিপূরক এবং আমদানি করা ফলের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর কেন উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে? এ পণ্যগুলো এখন আর বিলাসপণ্য নয়। এসব শুল্ক একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা তৈরি করে, যেখানে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো এ প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য থেকে বঞ্চিত হয় বা বেশি অর্থ খরচ করে কিনতে বাধ্য হয়। এসব পণ্য কি সবার কাছে সহজলভ্য হওয়া উচিত নয়?’ তিনি বলেন, শুধু ধনীরাই এ ধরনের খাদ্যপণ্য ভোগ করার সামর্থ্য রাখে।
আবদুল মজিদ বলেন, পরোক্ষ করের ওপর বেশি নির্ভর না করে বাংলাদেশের উচিত প্রত্যক্ষ ও বিস্তৃত করের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেয়া। এ পদ্ধতিটি তুলনামূলক ন্যায্য হবে কারণ এতে নিম্ন-আয়ের গোষ্ঠীর ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বোঝা তৈরি হবে না। এ গোষ্ঠীটি ইতোমধ্যেই পরোক্ষ করের বোঝায় জর্জরিত।
এনবিআরের উপাত্ত অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কর্তৃপক্ষ তিন লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আহরণ করেছে যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আমদানি কর ও স্থানীয় উৎসের মূল্য সংযোজন করের মতো পরোক্ষ কর থেকে এসেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআর-এর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ এক হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে আমদানি কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ এক হাজার কোটি টাকার বেশি।
উচ্চ ট্যারিফ স্তরের ফলে খরচ বাড়বে গ্রাহকের: অর্থনীতিবিদ জায়েদী সাত্তার বলেন, ভোগ্যপণ্যের আমদানি শুল্কের হার দেশের অন্যান্য পণ্যের তুলনায় অনেক বেশি। ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে গড় নমিনাল প্রটেকশন রেট ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশি ভোক্তাদের আন্তর্জাতিক বাজারের গড় মূল্যের তুলনায় একটি পণ্যের জন্য ৪৫ শতাংশ বেশি খরচ করতে হয়।
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, আমরা দেখতে পেয়েছি, আমদানিকৃত পণ্যের ওপর বাংলাদেশি ভোক্তাদের যে অতিরিক্ত শুল্ক দিতে হয় তা জিডিপির প্রায় ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার ৩০ শতাংশ অবমূল্যায়নের কারণে কোনো আমদানি করের হার বৃদ্ধি ছাড়াই রাজস্ব বোর্ডের আমদানি ট্যারিফ একই সঙ্গে সমহারে বেড়েছে বলে জানান জায়েদী। সুতরাং রাজস্ব বোর্ডের উচিত আমদানি কর কমপক্ষে ১৫ শতাংশ কমানো।
এনবিআরের শুল্কনীতি বিষয়ক সাবেক সদস্য লুৎফর রহমান বলেন, যদিও আসন্ন বাজেটে কিছু পণ্যের শুল্ক কমতে পারে, অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে নতুন কর আরোপ বা সম্পূরক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, উচ্চ আমদানি শুল্ক ভুল ঘোষণার ঝুঁকি বাড়ায়। তাই এগুলো একটি যুক্তিসঙ্গত স্তরে নামিয়ে আনা উচিত। এটি মসলার জন্য বিশেষভাবে সত্য। মসলা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় না এবং এটির ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ উচিত নয়। যদিও আমদানি পণ্যের বিকল্প পণ্য উৎপাদনকারী স্থানীয় শিল্পগুলোকে রক্ষা করার জন্য ট্যারিফকে ন্যায়সঙ্গত করা যেতে পারে, তবে অন্যান্য পণ্যের ওপর মাত্রাতিরিক্ত উচ্চ ট্যারিফ বরং উলটো প্রভাব ফেলে।
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ