রাজস্ব আয় বাড়াতে নানা পরিকল্পনা করছে সরকার। এতে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর বাড়ানো হবে ভ্যাট। অন্যান্য বছরগুলোতে যেসব পণ্য ও সেবায় কর অব্যাহতি দেয়া হতো— এবার তা কমবে। বাতিল করা হতে পারে গাড়ি আমদানিতে এমপিদের শুল্কমুক্ত সুবিধা। মোবাইলে কথা বলতেও বাড়বে খরচ। প্রস্তাবিত বাজেটে অনেক পণ্য ও সেবার ওপর বসছে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। যা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভাষায় যা স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাট রেট। এসব পণ্য ও সেবায় একই হারে ভ্যাট করার প্রস্তাবনা রয়েছে। তবে একসঙ্গে না বাড়িয়ে তা ধাপে ধাপে প্রয়োগ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এর ফলে উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ভ্যাটের হার হবে ১৫ শতাংশ (যেসব পণ্যের জন্য নির্ধারণ হবে)। যে কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে বিভিন্ন পণ্য ও সেবা ভেদে ২, ৩, ৫, সাড়ে ৭, ১০ ও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করে এনবিআর। অন্যদিকে ভ্যাটের অভিন্ন হারের মতো কয়েকটি খাতে ভ্যাট অব্যাহতিও ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। গত ১৪ মে গণভবনে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বাজেট বিষয়ক সভায় বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে এনবিআর চেয়ারম্যান, আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস অনুবিভাগের বাজেট বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। এনবিআর চেয়ারম্যান ছাড়াও তিন অনুবিভাগের নীতি শাখার সদস্য, প্রথম সচিব, দ্বিতীয় সচিব ও বাজেট সমন্বয়কারী দলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন অর্থসচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার।
বৈঠকে অংশ নেয়া নাম না প্রকাশ শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সরকার ভ্যাটের স্ট্যান্ডার্ড রেট ১৫ শতাংশ কার্যকর করার দিকে এগোচ্ছে। তবে আগামী অর্থবছরেই সবক্ষেত্রে এর বাস্তবায়ন হবে না। বাস্তবায়ন হবে ধাপে ধাপে। অন্যদিকে উৎপাদনশীল খাত ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া ভ্যাট অব্যাহতির ক্ষেত্র কমে যাবে আগামী বাজেটে।
মোবাইলে কথা বলতে বাড়ছে খরচ: রাজস্ব আদায়ের আওতা বৃদ্ধি করতে মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাবে ইতিবাচক সায় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এর ফলে মোবাইলে কথা বলতে আরও বাড়তি অর্থ গুনতে হবে ভোক্তাকে। বর্তমানে একজন ভোক্তা মোবাইলে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৭৩ টাকার কথা বলতে পারেন। বাকি ২৭ টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসেবে কেটে নেয় মোবাইল অপারেটরগুলো। প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল সেবার ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলে ভোক্তা ৬৯.৩৫ টাকার কথা বলতে পারবেন।
ভ্যাট আদায় বাড়াতে ২০১৫-১৬ সালের বাজেটে প্রথমবার মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপরে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়। প্রথমে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হলেও বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরে তা কমিয়ে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এর ২ বছর পর সম্পূরক শুল্ক ৩ থেকে বাড়িয়ে আগের ৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ২০১৯ সালে এটি ১০ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ১৫ শতাংশ করা হয়। বর্তমানে মোবাইল ফোনে কথা বলায় ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপিত আছে। অন্যদিকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আছে। এর সঙ্গে ভোক্তাদের এক শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়।
গাড়ি আমদানিতে এমপিদের শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল: বর্তমানে সংসদ সদস্যরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করতে পারেন। বৈষম্য হ্রাসে বাজেটে এ সুবিধা বাতিলের পক্ষে সায় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে গাড়ি আমদানি করতে হলে সংসদ সদস্যদের ২৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাবনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি হাইটেক পার্কের জন্য আমদানি করা গাড়ি শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলেও আগামী বাজেটে শুল্ক আরোপের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
অপরিবর্তিত ব্যাগেজ রুল: বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী একজন যাত্রী ১১৭ গ্রাম সোনা আনতে পারেন। এক্ষেত্রে চার হাজার টাকা শুল্ক দিতে হয়। একজন যাত্রী যতবার খুশি ততবার এভাবে সোনা আনতে পারেন। এনবিআর প্রস্তাব দিয়েছিল, একজন যাত্রী যাতে বছরে একবার এ নিয়মের আওতায় সোনা আনতে পারেন। তবে প্রধানমন্ত্রী এতে ভেটো দিয়ে বলেন, একজন যাত্রী যদি বছরে একবারও সোনা আনেন, তাও যেন কর আদায় হয়। একাধিকবার আনলেও কর দিতে হবে।
কমছে করপোরেট করহার: শর্তসাপেক্ষে করপোরেট কর কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। যাতে সায় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে ঢালাওভাবে সব খাতে নয়, আগের মতো উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে জড়িত পুঁজিবাজারে তালিকাবহির্ভূত শিল্পের কর কমানো হচ্ছে। এ জাতীয় কোম্পানির কর সাড়ে ২৭.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাকি সব খাতের কর অপরিবর্তিত থাকছে।
কৃষি উপকরণ ও সার আমদানিতে শুল্ক সুবিধা: কৃষি উপকরণ ও সার আমদানিতে শুল্ক না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ফলে সার আমদানি ও কৃষি উপকরণ আমদানি ব্যয় বাড়ছে না বলে জানা গেছে।
রিটার্ন অ্যাসেসমেন্ট বাতিল: রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিসহ করদাতাদের হয়রানি কমাতে আগামী বাজেটে ব্যক্তি ও কোম্পানি সব শ্রেণির করদাতাকে স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন জমা দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে রিটার্ন অ্যাসেসমেন্ট করা হয় না। বর্তমানে ব্যক্তি করদাতাদের স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন জমা দিতে হয়। অন্যদিকে কোম্পানি করদাতারা স্বনির্ধারণী ও সাধারণ-দুই নিয়মেই রিটার্ন জমা দিতে পারেন। সাধারণ নিয়মে জমা দেয়া রিটার্ন অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে চূড়ান্ত কর আদায় করা হয়। আর স্বনির্ধারণী পদ্ধতির রিটার্ন অডিট করা হয়। এজন্য আগামী বাজেটে এনবিআর আয়কর আইনে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে না: মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে। অবশ্য রাজস্ব বাড়াতে বিত্তশালীদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায়ে ছক আঁকছে এনবিআর। বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ রয়েছে। বছরে সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় থাকলে ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। এটিকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, এ প্রস্তাবে সায় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়া বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতি কমানো, শেয়ার বাজারের বিনিয়োগে মূলধনি আয়ের ওপর কর ছাড় বাতিল করার নির্দেশনা এসেছে বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়োছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ