ঢাকা, শনিবার, ৬ জুলাই ২০২৪, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

টিকে থাকার লড়াইয়ে তৈরি পোশাক খাত

প্রকাশনার সময়: ১৭ মে ২০২৪, ০৮:২৮

দেশে রপ্তানি খাতের অন্যতম চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক। নানাবিধ কারণে বাড়তি তৈরি পোশাকের উৎপাদন খরচ। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানিকারকরা দাম না বাড়িয়ে বরং কমিয়েছেন। গত বছরের ডিসেম্বরে নতুন মজুরি কার্যকর হওয়ার পর তারা তৈরি পোশাকের দাম বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ৮০ ভাগ কারখানার মালিক বলেছেন— বিদেশি ক্রেতারা এখনো বাংলাদেশি পোশাকের দাম বাড়াননি। ফলে রপ্তানিকারকরা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাঝারি ও ছোট কারখানার মালিকরা টিকে থাকার লড়াই করছেন।

জানা যায়, গত ডিসেম্বর মাস থেকে পোশাক খাতের নতুন মজুরি কার্যকর হয়। সেখানে মূল মজুরি ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে মিল রেখে বিদেশি ক্রেতারাও যেন পোশাকের মূল্য বাড়িয়ে দেন সেই দাবি ছিল মালিকদের পক্ষ থেকে। বিজিএমইএর তৎকালীন সভাপতি ফারুক হাসান পণ্যের মজুরি বৃদ্ধির জন্য ক্রেতাদের বিভিন্ন সংগঠনের কাছে চিঠিও দিয়েছিলেন। মজুরি বৃদ্ধির সময় শ্রমিকদের দাবি ছিল ন্যূনতম মুজরি যেন মাসে ২০ হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে থাকে। তবে মালিকরা সে দাবিতে রাজি হননি, সরকার গঠিত মজুরি বোর্ডও মালিক শ্রমিকের দাবির মাঝামাঝি একটা জায়গায় এসে সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় এক হাজার পশ্চিমা ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জোট আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন গণমাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছিল, মজুরি বৃদ্ধির কথা বিবেচনায় নিয়ে পোশাকের ক্রয়মূল্য ৫ থেকে ৬ শতাংশ বাড়াতে রাজি আছেন তাদের সদস্যরা। অবশ্য ২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে শ্রমিকদের দাবি পূরণ করার পক্ষেও ছিল ক্রেতা জোট। মজুরি বৃদ্ধির পর দুই একজন ক্রেতা পোশাক মূল্য সঠিকভাবে বাড়িয়েছেন। বাকিদের কেউ কেউ ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ বাড়তি ব্যয়টি সমন্বয় করেছেন। আবার অনেকে আছেন দাম বাড়াবেন বলে আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু মজুরি বৃদ্ধির পর অধিকাংশ ক্রেতাই এখনো পোশাকের দাম বাড়াননি। এদিকে সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়— দেরি ও অন্যান্য কারণে ২০২৩ সালে শুল্ক ও বন্ডের খরচ এর আগের বছরে তুলনায় ৪৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পশ্চিমের ক্রেতারা উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে থাকায় গত বছর দেশের পোশাক কারখানাগুলোর সক্ষমতার প্রায় সাড়ে ২৭ শতাংশ অব্যবহূত ছিল। আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতারা পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি বাস্তবায়নের পর পোশাকের দাম বাড়াননি বলেও জরিপে উঠে এসেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে শতাধিক পোশাক কারখানার মালিকদের নিয়ে এ জরিপ চালায় বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) একটি অংশ। জরিপের মতে, গত বছর গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করা হলেও মালিকরা এখনো জ্বালানি সংকটে ভুগছেন। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের কারণে ২০২২ সাল থেকে পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করে। শক্তিশালী আর্থিক অবস্থা না থাকায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের কারখানাগুলো চলমান সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জানা যায়, ২০২৩ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে মাত্র নয় শতাংশ কারখানায় পূর্ণ কার্যাদেশ ছিল, ৮২ শতাংশ কারখানার সক্ষমতার চেয়ে কম কার্যাদেশ ছিল এবং ছয় শতাংশ কারখানায় কোনো কার্যাদেশ ছিল না। কোনো কোনো কারখানার মালিক বাধ্যতামূলক ঋণের ঝুঁকিতে আছেন। কেননা, অনেক ক্রেতা রপ্তানি পণ্যের ছয় থেকে সাত শতাংশ মূল্য এখনো পরিশোধ করতে পারেননি। বিজিএমইএ সভাপতি এসএম মান্নান কচি বলেন, গত পাঁচ বছরে তৈরি পোশাকশিল্পকে নিরাপদ করতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। এসবের পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সেবার দামও বেড়েছে ধাপে ধাপে। ঋণের হার সিঙ্গেল ডিজিট থেকে বেড়ে ১৩-১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাকশিল্পের ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতারা পণ্যের দাম না বাড়িয়ে বরং কিছু ক্ষেত্রে কমিয়েছে। ফলে রপ্তানিকারকরা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাঝারি ও ছোট কারখানার মালিকরা বেঁচে থাকার লড়াই করছেন। তৈরি পোশাকশিল্পের একজন উদ্যোক্তা ও নেতা হিসেবে আমার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হবে খুচরা বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ডের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পোশাক প্রস্তুতকারকদের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ও বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক জায়গায় থাকতে বৈশ্বিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড এবং খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্য পাওয়া পোশাক খাতের জন্য এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তিনি বলেন, তরি পোশাক পণ্যের ক্রেতাদের মধ্যে একটি সাধারণ প্রবণতা হলো তারা সর্বদা কম দাম প্রস্তাব করে। আবার সব ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে বলে। আমরা নিরাপত্তা মান ও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার জন্য তাদের দাবি মেনে চলি। কিন্তু তারা আমাদের পণ্যের মূল্যের প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন না। বাংলাদেশে সফররত ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ (ইউএসটিআর) দলের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে আমাদের ন্যায্যমূল্যের দাবি ব্যক্ত করেছি। তাদের ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে তা তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছি। বিজিএমইএ থেকে আমরা পোশাকসামগ্রীর ন্যায্য ন্যূনতম মূল্য ও সামাজিক নিরীক্ষার জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ আচরণবিধি নিশ্চিত করতে মার্কিন সরকারের সমর্থন এবং সহযোগিতা চেয়েছি। পর্যায়ক্রমে আমরা বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার ও ক্রেতার প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে দেখা করব, যেখানে ন্যায্যমূল্যের বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে। অন্যদিকে আমরা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি তাদের ক্রেতাদের কাছে তুলে ধরার জন্য আহ্বান জানাব। দাম না বাড়ালে এ খাতের পক্ষে টিকে থাকা খুবই কঠিন হবে। সক্রিয় কারখানার সংখ্যা গত কয়েক বছরে পাঁচ হাজার থেকে ২২শ-এ নেমে এসেছে। এ শিল্প টিকিয়ে রাখা সবার দায়িত্ব। আমি বিশ্বাস করি আমাদের অংশীদাররা এটি বিবেচনা করবে এবং নির্মাতাদের জন্য আরও ভালো দাম দেবে। তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করতে নিরাপত্তার মানোন্নয়নে বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ব্র্যান্ডের সহযোগিতা, সরকারি সহায়তা এবং উদ্যোগক্তাদের বিপুল বিনিয়োগের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প এখন সবচেয়ে নিরাপদ শিল্প। বাংলাদেশে ২১৫টি গ্রিন সার্টিফায়েড কারখানা রয়েছে, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রতিযোগী দেশের তুলনায় টেকসই। ফলে তৈরি পোশাক আমদানিকারকদের কাছে বাংলাদেশ নির্ভরযোগ্য গন্তব্য। বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে আমাদের এ বিষয়গুলো ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে হবে।

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ