ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ঝুঁকি

প্রকাশনার সময়: ১২ মে ২০২৪, ০৯:৫০

সংকটের মধ্যে ডলারের দাম বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১১৭ টাকা দাম নির্ধারণ করলেও ডলারের দাম গিয়ে ঠেকেছে ১২৫-তে। হঠাৎ চালু হওয়া স্মার্ট সুদহার পদ্ধতিও বাতিল করে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এসব কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, হঠাৎ ডলারের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। সুদহার বেড়ে গেলে ব্যবসায়ীরা দুর্দশায় পড়বেন। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। হু হু করে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। এর প্রভাব পড়বে নিত্যপণ্যের ওপর। জনগণের ঘাড়েই চেপে বসবে পণ্যের দাম বৃদ্ধি।

অথচ আগে থেকেই পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। এরই মধ্যে ডলারের দামের আকস্মিক উচ্চলাফে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বাড়ায় নিম্ন-মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার মান কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা, মূল্যস্ফীতির চাপে নতুন করে আরও কয়েক লাখ মানুষ দরিদ্র বা অতিদরিদ্রের কাতারে গিয়ে দাঁড়াবে। এতে অর্থনৈতিক অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধিরও ব্যাপক শঙ্কা দেখা দিয়েছে। উচ্চ আয়ের মানুষ মূল্যস্ফীতির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও নানামুখী সংকটের সম্মুখীন হবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা আরও কমবে।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই ডলারের বাজারে চলছে অস্থিরতা। এ সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্ধারণ করে দেয়া দরে বাজারে ডলার মিলছিল না। এ পরিস্থিতিতে প্রবাসী আয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছিল অবৈধ হুন্ডির বাজারে। আবার আমদানিকারকরা ঘোষিত দরের চেয়ে ১০-১৫ টাকা বেশি দিয়ে ডলার কিনতে বাধ্য হয়। এ পরিস্থিতিতে চলতি বছরের প্রথম দিকে এসে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে কীভাবে এ পদ্ধতি চালু হবে, সে বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এতে গেল মার্চের মধ্যে এ পদ্ধতি কার্যকরের কথা থাকলেও এর ঘোষণা আসতে চলতি মে মাস পর্যন্ত লেগে যায়।

ডলারের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর গত বুধবার বিকালে খোলাবাজারে ১১৯ টাকায় উঠে যায়। যা সকালে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। এছাড়া ব্যাংকগুলোতে দর ছিল ১১৫ থেকে ১১৬ টাকা। পরের দিন বৃহস্পতিবার ১২৫ টাকায় গিয়ে ঠেকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, এ সিদ্ধান্তের বড় প্রভাব পড়বে সরকারের ব্যয়ে। কেননা সার, বিদ্যুৎ, খাদ্যসহ বিভিন্ন আমদানির দায় মেটাতে সরকার ১১০ টাকায় ডলার পেত। এখন ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা দরে কিনতে হবে। এর ফলে ব্যয় অনেক বাড়বে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের প্রভাবে দেশে বিরাজমান মূল্যস্ফীতি আরও উসকে উঠতে পারে। এতে নাজুক অবস্থায় যেতে পারে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, শুধু সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। এর জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে হবে। টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে হুন্ডির কবল থেকে উদ্ধার করতে হবে। তাহলে ডলারের দাম বৃদ্ধি ঠেকানো যাবে। তখন ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে অন্তত মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যাবে।

এছাড়া সিন্ডিকেটের কারসাজির মাধ্যমে যারা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমদানি-রপ্তানির নামে যেসব টাকা পাচার করা হয়, সেগুলো বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে। এতে পণ্যের দামে স্থিতিশীলতা আসবে। তখন মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।

তবে দ্রুত এ সংকটের সমাধান হবে এমনটা আশা করছেন না বাজার পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্য, ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে শুল্ক বৃদ্ধিসহ সব আমদানি পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। যা মুদ্রাস্ফীতিকেও উসকে দেবে। ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের কারণে আমদানির পাশাপাশি উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে। ফলে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত সব ধরনের পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে হঠাৎ করে ডলারের দাম এক লাফে ৭ টাকা বাড়ায় পণ্য আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি কতটা ঊর্ধ্বমুখী হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ। এখানে যদি ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে মানুষের কষ্ট হবে এবং দেশে এক ধরনের সংকটের সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিকল্পনা থাকা দরকার। এই ব্যবসায়ী নেতার শঙ্কা, ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বাড়ায় আমদানিতে সাংঘাতিক প্রভাব পড়বে। পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাবে অনেক, পণ্যের দামও বাড়াতে বাধ্য হবে আমদানিকারকরা।

ডলারের বাড়তি দাম নিয়ে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ডলারের দাম ১১০ থেকে ১১৭ টাকা হয়েছে- এটা গার্মেন্টস মালিকদের জন্য ভালো সংবাদ। কিন্তু দেশের জন্য ভালো সংবাদ নয়। ডলারের দাম বাড়ার ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং জনগণের ওপর চাপ বাড়বে। এছাড়া ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানি ব্যয় বাড়বে। কিছু কিনতে গেলে বেশি দাম দিতে হবে; যার ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।

এদিকে নতুন দরে কেনা ডলারে আমদানির ঋণপত্র খোলা এখনো শুরু না হলেও এরই মধ্যে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে প্রসাধনী পণ্যের দাম গত ২৪ ঘণ্টায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। যা কয়েক দিনে আরও অনেকটা বাড়বে বলে শঙ্কা করছেন খোদ ব্যবসায়ীরা।

আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যের দামও হু হু করে বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য, ডলারের দর বাড়ায় তাদের বেশি দামে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে হবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের বাড়তি দরে পণ্য বিক্রি করতে হবে। এ সুযোগ কোনো কোনো আমদানিকারক ও মজুতদার তাদের আগের আমদানিকৃত পণ্য বাজারে ছাড়তে ঢিলেমি করবে। যাতে পরবর্তীতে বাজারে দর চড়লে তা তারা বেশি দামে বিক্রি করতে পারে।

বর্তমানে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ হয়েছে বলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বাড়লে দেশে এক বেলা কম খাওয়া মানুষের সঙ্গে কয়েক গুণ বাড়বে বলে গবেষকরা আশঙ্কা করছেন।

চলতি বছরের শুরু থেকেই ক্রমাগত ঋণের সুদহার বাড়ালেও এখনো দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। টানা গত ২২ মাস ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে।

যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের সবশেষ হিসাবে, গত মার্চ মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্য বলছে, মার্চ মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় মূল্যস্ফীতিই বেড়েছে। মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৪৪ এবং ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ১১৭ টাকা যে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, ক্রলিং পেগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা গেলে ভালো। তবে এতে মূল্যস্ফীতি বাড়ার সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে।

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ