মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করেছে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতির আওতায় ডলারের মধ্যবর্তী একটি দাম নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলোকে এ দামের আশপাশে স্বাধীনভাবে লেনদেন করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মধ্যবর্তী এই দাম ৭ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। নতুন এ সিদ্ধান্তের ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ।
বিষয়টি নিয়ে বুধবার (৮ মে) বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনে এ ঘোষণা দেন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এখন থেকে ক্রলিং পেগ নামের নতুন পদ্ধতিতে ডলার কেনাবেচা হবে। এ পদ্ধতিতে ডলারের রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। কিন্তু গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দাম ছিল ১১০ টাকা, যা ছিল অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাফেদা নির্ধারিত।
এছাড়া স্মার্ট লেন্ডিং রেট প্রক্রিয়াও বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মনিটারি পলিসি কমিটি। সভার পরে জারি করা এক সার্কুলারে জানানো হয়েছে, এখন থেকে ব্যাংকগুলো চাহিদা-সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে লেন্ডিং রেট বা ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে।
এ পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেয়া হয়। এতে নির্দিষ্ট বিনিময় হার ব্যবস্থার কিছু বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি ভাসমান বিনিময় হার ব্যবস্থার কিছু সুবিধাও থাকে। এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের একটি সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে বা আবার কমতে পারবে না। বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় করার পরামর্শ দিয়ে আসছিল। আইএমএফের চাওয়া, বাংলাদেশ ব্যাংক যেন বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পথে এগোয়। এক সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার দাম নির্ধারণ করে দিলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্যাংকভিত্তিক দুটো সংগঠন ডলারের দাম ঠিক করে আসছিল। সর্বশেষ তারা ডলারের আনুষ্ঠানিক দর ১১০ টাকায় নির্ধারণ করেছিল। ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে ওঠানামা করে। নতুন পদ্ধতিতে অর্থনীতির বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ডলারের দাম একটা সীমার মধ্যে বাড়বে বা কমবে। ফলে ডলারের দাম একবারে খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চসীমা ও নিম্নসীমা নির্ধারণ না করে মধ্যবর্তী সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে ডলারের লেনদেনের ক্ষেত্রে এ দরের আশপাশে থাকতে বলা হয়েছে।
ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার আগে এ পদ্ধতি চালুকে কার্যকরী একটি পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেন বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংকগুলো এখন ১১৭ টাকার নিচে বা ওপরে ডলারের কেনাবেচা করতে পারবে। তবে এ দরের চেয়ে খুব বেশি কম বা বেশি দামে ডলারের লেনদেন করা যাবে না। প্রতিদিন কত দামে ডলার কেনাবেচা করছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সেটা জানিয়ে দিতে হবে। ক্রলিং পদ্ধতি চালুর ফলে চলমান ডলার-সংকট অনেকটা কেটে যাবে বলে মনে করেন এ ব্যাংকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে আমদানি ও রপ্তানি থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রাহকের কাছে কত দরে ডলার কেনাবেচা করা হবে, তা ঠিক করত বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। এখন থেকে ডলারের দাম নির্ধারণে বাফেদা বা এবিবির কার্যত কোনো ভূমিকা থাকবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কীভাবে এ পদ্ধতি চালু হবে, তা নিয়ে আইএমএফের শরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত মার্চের মধ্যে এ পদ্ধতি চালু করার কথা বললেও মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দিল।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় আমদানি খরচ বেড়ে যাবে, দাম বাড়বে পণ্যের। চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমদানিতে।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি এবং বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, আমাদের দেশ আমদানিনির্ভর। দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের অর্থনীতি চাপে আছে। এখন হঠাৎ করেই ডলারের দাম খুব বেশি হলে এর নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হবে। বিশেষ করে আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাবে। এতে পণ্যের দামও বাড়াতে বাধ্য হবেন আমদানিকারকরা।
তিনি বলেন, হঠাৎ করেই ডলারের বেশি দাম বাড়ার এমন সিদ্ধান্তে চাপে পড়বেন সাধারণ মানুষ। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে, মানুষ কষ্ট পাবেন। তবুও আমাদের অর্থনীতি একটা জায়গায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে ধীরে ধীরে দাম বাড়লে হয়তো কষ্ট কিছুটা কম হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে সবদিক বিবেচনায় নেওয়া।
এ নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধারক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ডলারের রেট ১১৭ টাকা নির্ধারণ ক্রলিং পেগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা গেলে ভালো। তবে এতে মূল্যস্ফীতি বাড়ার সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে।
এর আগে গত ৫ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহারকে বাজারভিত্তিক করবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সংশোধনে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করা হবে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একটি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়নে এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের সঙ্গে কাজ করছে। বিশ্বব্যাংক গত ২ এপ্রিল জানিয়েছিল, ক্রলিং পেগকে একটি ‘মার্কেট-ক্লিয়ারিং’ বিনিময় হার পদ্ধতি হতে হবে, যা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের মধ্যেকার ব্যবধান কমাবে। দাতাসংস্থাটি তাদের সাম্প্রতিকতম বাংলাদেশ উন্নয়ন আপডেট প্রতিবেদনে আরও বলেছে, এটি আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ আকৃষ্ট করে বৈদেশিক মুদ্রার বাফার পুনর্গঠনে সহায়তা করবে। এবং আর্থিক হিসাবের ঘাটতি কমিয়ে বাণিজ্য ঋণ ও অন্যান্য ধরনের বৈদেশিক অর্থায়ন বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও মার্কিন ডলারের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর পক্ষে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্যাকেজ অনুমোদনের সময় বাংলাদেশকে বেশকিছু শর্ত দিয় আইএমএফ। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়া অন্যান্য প্রায় সব শর্তই পূরণ করে ঋণের দুটি কিস্তিও পেয়েছে বাংলাদেশ।
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ