বাজারে অর্থ সরবরাহ ঠিক রাখা এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘রিভার্স রেপো রেট’-এর মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংককে দেয়া ঋণের পরিমাণ কমিয়েছে। যা আগের তুলনায় কমেছে ১০ শতাংশ। অর্থ সরবরাহ কঠোর করার পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন ব্যাংকাররা।
তারা বলছেন, যদি ব্যাংকগুলো জানে তারা যা চায় তার থেকে ১০ শতাংশ কম পাবে। তাহলে যা প্রয়োজন তার থেকে ১০ শতাংশ বেশি দাবি করবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক থেকে ১৪ দিনের জন্য রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয় এবং এ ঋণের জন্য ৮ শতাংশ সুদ নিয়ে থাকে। যা সাধারণত সর্বনিম্ন ঋণের হার হিসাবে বিবেচিত হয়।
বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের জুলাইয়ে মুদ্রানীতি ঘোষণার পর থেকে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ব্যাংকগুলোর চাওয়া সব টাকাই দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে গত এক সপ্তাহ ধরে তা করছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৭ এপ্রিল ব্যাংকগুলোর চাহিদার চেয়ে ৫ শতাংশ কম এবং ১৮ এপ্রিল ১০ শতাংশ কম ধার দিয়েছে। এরপর থেকে প্রতিদিনই একই নিয়মে ধার দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, রেপোর মাধ্যমে অর্থ সরবরাহ ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ অর্থ চেয়েছে, আমরা তার থেকে ১০ শতাংশ কম সরবরাহ করেছি। মুদ্রানীতি অনুসারে, আমরা একটি নির্দিষ্ট স্তরে আমাদের দেশে অর্থ সরবরাহ বজায় রাখার জন্য চেষ্টা করছি। আমাদের হিসাবে বর্তমানে ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত অর্থ রয়েছে, যা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, তাই আমরা অর্থ সরবরাহ কিছুটা কমানোর পরিকল্পনা করছি।
সর্বশেষ মুদ্রানীতি সুদের হারভিত্তিক। যা আগে রিজার্ভ মানিভিত্তিক ছিল। অর্থাৎ আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করত। এখন সুদের হার বাড়িয়ে বা কমিয়ে তা বজায় রাখা হয়।
সুদের হার বৃদ্ধি না করে কেন রিজার্ভ মানি সরাসরি কমানো বা বাড়ানো হচ্ছে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমরা মুদ্রানীতিতে বর্ণিত সুদভিত্তিক ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করি। আমাদের মতো অর্থনীতিতে অর্থ সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে সুদের হার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
তিনি বলেন, আমরা অর্থ সরবরাহের জন্য নির্দেশমূলক লক্ষ্য নির্ধারণ করি এবং সেই অনুযায়ী রিজার্ভ মানি মূল্যায়ন করি। অতীতে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকতাম। তবে আমরা সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে সমন্বয় করছি।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অর্থ সরবরাহ কঠোর করার পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেন, যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এভাবে ঋণ কমিয়ে দেয় তবে ব্যাংকগুলোও সে অনুযায়ী অর্থের জন্য তাদের অনুরোধগুলো সামঞ্জস্য করবে। কারণ যদি ব্যাংকগুলো জানে তারা যা চায় তার চেয়ে ১০ শতাংশ কম পাবে, তাহলে পরের দিন থেকে তারা তাদের প্রকৃতপক্ষে যা প্রয়োজন তার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি দাবি করতে শুরু করবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নীতিমালা করেছে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ব্যাংকগুলো রেপো বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য নিশ্চিত তারল্য সহায়তা সুবিধা এবং ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সুবিধার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রতিদিন ১২ হাজার কোটি থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে। ১ এপ্রিল একদিনে ব্যাংকগুলো মোট ২৫ হাজার ৬৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ১৭ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে ১৫ হাজার ২৪০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, গত এক মাসে ব্যাংকগুলোতে টাকার চাহিদা বেড়েছে। ঈদের আগে সাধারণত চাহিদা বেড়ে যায়। যাই হোক, এ মৌসুমি বৃদ্ধি ছাড়াও, রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে চলে যাচ্ছে, কার্যকরভাবে সামগ্রিক অর্থ সরবরাহ হ্রাস করছে।
তারা আরও বলেন, বিভিন্ন অনিয়মের কারণে অনেক ব্যাংক তাদের নগদ প্রবাহ দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে বেশ কয়েকটি ব্যাংক অর্থ ধার করতে বাধ্য হচ্ছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন কারণে রিজার্ভ মানি কমাতে পারে। তবে বাজারে এর প্রভাব দেখতে কিছুটা সময় লাগে। তারা (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) অর্থ সরবরাহ কমিয়ে বাজারের প্রভাব বোঝার চেষ্টা করা হতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৭ এপ্রিল একটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে কল মানি মার্কেটে রাতারাতি অন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গড় সুদের হার ৮.৮৭ শতাংশ দিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৯.৫ শতাংশ সুদ হারে ঋণ নিয়েছে। ১৮ এপ্রিল বাজার থেকে ব্যাংকগুলো ৩ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
উল্লেখ্য, ‘রিভার্স রেপো রেট’ হলো একটি রেপো বা বিক্রয় এবং পুনঃক্রয় চুক্তি নামেও পরিচিত। স্বল্পমেয়াদি ঋণের একটি রূপ। তফসিলি ব্যাংগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অন্তর্নিহিত সিকিউরিটি বিক্রি করে এবং দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে, কিছুক্ষণ পরই, সাধারণত পরের দিন, কিছুটা বেশি দামে তা ফেরত নিয়ে নেয়।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ