ডলার সংকটে মন্দাভাব দেখা দেয় দেশের অর্থনীতিতে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে কৃচ্ছ্র সাধনের পথে হাঁটে সরকার। কড়াকড়ি আরোপ করা হয় এলসি খোলায়। লাগাম টানা হয় উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে। এতে গত অর্থবছর আমদানি কমে প্রায় ১৬ শতাংশ। যদিও রপ্তানি আয়ে কিছুটা প্রবৃদ্ধি হয়। তবে সার্বিকভাবে অর্থনীতির জন্য অস্বস্তিকর সময় কেটেছে পুরো অর্থবছর জুড়েই, যা চলতি অর্থবছরও অব্যাহত রয়েছে।
চলতি অর্থবছর প্রথম প্রান্তিকে আমদানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয় ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। মূলত গত অর্থবছর আমদানিতে বড় ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির কারণে চলতি অর্থবছর এ হার কমে যায়। তবে আর্থিকভাবে আমদানি হ্রাসের চিত্র অনেক বড়। কারণ চলতি অর্থবছর দ্বিতীয় প্রান্তিকে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছর দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা ছিল ১৮ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার আমদানি হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমদানি ব্যয় পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা ধরনের কড়াকড়ি নীতি গ্রহণের ফলে আমদানি প্রবৃদ্ধি কমেছে। পাশাপাশি ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্য বৃদ্ধির কারণেও অনেক পণ্যের আমদানি হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া খাদ্যশস্য বিশেষত ভোগ্যপণ্য, মাধ্যমিক পণ্য (বিশেষত জ্বালানি তেল, তুলা, তৈলবীজ, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য এবং আয়রন, স্টিল ও অন্যান্য ধাতুজ পণ্য), মূলধনি যন্ত্রপাতি ও মূলধনি পণ্য আমদানি হ্রাস এ খাতের প্রবৃদ্ধি হ্রাসে বড় ভূমিকা রেখেছে।
সূত্রমতে, এলসি খোলায় ২০২২ বছরের শুরু থেকেই সরকার কড়াকড়ি আরোপ করে। বিশেষত বিলাস দ্রব্যের আমদানি কঠোর করা হয়। তবে ডলার সংকট ও সরকারের নিয়ন্ত্রণের কারণে জুলাই থেকে তা আরও কঠোর করা হয়। এ সময় প্রায় সব ধরনের পণ্যের এলসি খোলায় যাচাই-বাছাই শুরু করে। এতে গত অর্থবছর দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে আমদানি কমতে শুরু করে। এছাড়া এলসি সেটেলমেন্টও কমেছে এ সময়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর আমদানি প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ঋণাত্মক ছিল আগস্টে। ওই মাসে আমদানি প্রবৃদ্ধি ২৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ ঋণাত্মক ছিল। পরের মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়, যা ছিল ২৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর নভেম্বরে ২২ দশমিক ৪০ শতাংশ, যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। অপর মাসগুলোর মধ্যে জুলাইয়ে আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ছিল ১৫ দশমিক ০৪ শতাংশ, ডিসেম্বরে ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ ও অক্টোবরে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানিতে বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যদিও জুলাইয়ের পর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধি ক্রমেই হ্রাস পেয়েছে। তবে দ্বিতীয় (অক্টোবর-ডিসেম্বর) প্রান্তিকে আমদানি প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের পতন হয়। প্রথম প্রান্তিকের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি থেকে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১৩ শতাংশের বেশি নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয় আমদানিতে। মূলত আমদানিতে সরকারের রাশ টানা ও এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপই ছিল এর মূল কারণ।
সরকারের নীতির প্রভাব গত অর্থবছর আমদানি হ্রাস সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করে তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ)। এ সময় প্রায় ৩০ শতাংশ হ্রাস পায় আমদানি। চতুর্থ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) এ ধারা অব্যাহত ছিল। ওই সময় প্রায় ২৬ শতাংশ ঋণাত্মক আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়। এর ধারাবাহিকতা চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিকেও অব্যাহত ছিল।
যদিও ঋণাত্মকের হার কমে এসেছে। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে প্রায় ২৪ শতাংশ ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রায় ১৬ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয় আমদানিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছর আমদানি প্রবৃদ্ধি হ্রাসের মধ্যে অন্যতম ছিল মাধ্যমিক পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি। আমদানির এ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির প্রভাব অনেকটাই পড়েছে রপ্তানি খাতে। গত অর্থবছর প্রথম ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও তা ছিল ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে কম।
তবে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রান্তিকে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি একেবারে তলানিতে নামে। এ সময় দুই শতাংশের আশপাশে ছিল রপ্তানি প্রবৃদ্ধি। রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির কমার ধাক্কা চলতি অর্থবছর প্রথম প্রান্তিকে কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা খুবই খারাপ অবস্থায় চলে যায়। এ সময় সাত শতাংশের বেশি ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে রপ্তানিতে। যদিও প্রথম প্রান্তিকে আমদানিতে প্রায় ১০ শতাংশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। বাংলাদেশের বড় দুই রপ্তানি বাজার বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে গত বছর ধারাবাহিক রপ্তানি হ্রাসকে মূলত এজন্য দায়ী করা হচ্ছে। যদিও নতুন বাজারে এ সময় রপ্তানি বেড়েছে। তবে প্রধান দুই বাজারে রপ্তানি হ্রাসের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত অর্থবছর রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সোয়া ছয় শতাংশের বেশি। তবে দ্বিতীয়ার্ধে (জানুয়ারি-জুন) তা ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে যায়। যদিও অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি ছিল রপ্তানিতে। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছর সার্বিকভাবে আমদানি প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৬ শতাংশ ঋণাত্মক। তবে দ্বিতীয়ার্ধে তা সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছর ৫২ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ৪৯ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ছয় দশমিক ২৪ শতাংশ। তবে প্রান্তিকভিত্তিক চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথম প্রান্তিকে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৬৩ শতাংশ ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। তৃতীয় প্রান্তিকে এ প্রবৃদ্ধি নামে মাত্র এক দশমিক ৯০ শতাংশে ও শেষ প্রান্তিকে দুই দশমিক ১৬ শতাংশে।
এদিকে চলতি অর্থবছর প্রথম প্রান্তিকে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে সাত দশমিক ০৭ শতাংশ ঋণাত্মক। রপ্তানি আয়ে প্রায় ৮৫ ভাগ অবদান রাখা তৈরি পোশাক খাতে এ সময় প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ৪৩ শতাংশ অবদান রাখে ওভেন গার্মেন্টস ও ৫৭ শতাংশ নিটওয়্যার। এ দুই খাতে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে যথাক্রমে ১১ দশমিক ৪৮ ও চার দশমিক ১৭ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এদিকে বিদায়ী অর্থবছর আমদানি হয় ৬৯ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০২১-২২ অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ৮২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আমদানি ব্যয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে আমদানি ব্যয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। ওই সময় ১১ দশমিক ৭ শতাংশ আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়। দ্বিতীয় প্রান্তিকেই তা ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ ঋণাত্মক হয়। তৃতীয় প্রান্তিকে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি আরও খারাপ অবস্থায় যায়, যা ছিল ২৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর শেষ প্রান্তিকে ২৫ দশমিক ৮২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ